সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

আজান ও কুরআনি সুরের প্রভাব

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২
  • ৮৫ বার

সুর মহান রবের মহাসৃষ্টি। সুরের মধুময়তায়, সুরের মূর্ছনায় ক্ষণিকের তরে মানুষ অজানায় হারায়। মন মাতানো সুরের মোহনীয়তায় বিধাতার ধ্যানে সাধকরা জ্ঞানও হারায়। আর এ সুর মানুষের মনে জমে থাকা দুঃখকষ্ট, হৃদয়ে জমানো শত ব্যথাকেও দূর করে দেয় নিমিষে। মানুষকে টেনে নিয়ে যায় অতীতের চিরচেনা পথে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক রঙিন জগত। সুরের এ কারিশমা শুধু চোখের জল গলায় না; বরং হৃদয়কেও গলিয়ে দেয়।

পৃথিবীর চিরচেনা মধুময় সুর আজানের সুর। এ সুর মানুষকে বিধাতার কাছে চুম্বকের চেয়েও বেশি জোরে কাছে টানে, মহান বিধাতা আল্লাহর কুদরতি চরণে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য করে। পাপীদের হৃদয়ে অনুতাপ ও অনুশোচনা ভাব সৃষ্টির মাধ্যমে পাপরাজি ছেড়ে দিয়ে প্রাত্যহিক পুণ্যের পথে ও চিরসুখের নিত্যকর্মকাণ্ডে পরিচালিত করে। চিরসুখের উদ্যানের মনোলোভা নয়ন জুড়ানো ফুলেল পথে পদচালনায় প্রেরণা সৃষ্টি করে। ভয়ের পথকে জয়ের পথে রূপান্তরিত করে। নিরাশ ব্যক্তিকে পরমাত্মার সন্ধান লাভে খুবই আশাবাদী করে।

মহা মহীয়ানের সান্নিধ্য লাভের সহজতর সুরত হলো, আজানের সুললিত ও হৃদয়গ্রাহী পরম সুরে সাড়া দেয়া, দিবা-নিশি তাঁর করুণা লাভে ‘খুশুখুজু’ অবলম্বন করে সালাতে খাড়া হওয়া, যাবতীয় নেককাজে নিজেকে নিজে তাড়া দেয়া। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আল্লাহু আকবারের সুরলহরি, ইমামের পঠিত কিরাতের তারতিল, সালাতে একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা সত্যিকার অর্থে মুমিনের হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়া দেয়, কঠিন হৃদয়কে গলিয়ে দেয়। হৃদয় গলার সেই সুর আজানের সুর, সেই সুর তিলাওয়াতের সুর।

হৃদয় গলানো মধুর সুরে যাদের কঠিন হৃদয় গলেছে, তারা হলেন জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ, বিশেষ করে ওমর ইবনুল খাত্তাব রা:। জীনের প্রথম অধ্যায়ে তার হৃদয় ছিল ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। নবী সা: এবং তাঁর দ্বীনকে নিঃশেষ করে দেয়ার শপথে তিনি ছিলেন অটল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছেন নবী মুহাম্মদ সা:-কে শেষ করে দিতে, কিন্তু কে জানে? তার হৃদয় কুরআনি সুরে গলে যাবে, তিনিও গলে যাবেন পাল্টে যাবেন, অবশেষে তাই হলো। তিনি শুনলেন যে, বোন ও ভগ্নিপতি মুসলিম হলেন, রাগের মশাল জ্বালিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে গেলেন বোনের বাড়িতে। শুনতে পেলেন জাদুমাখা সুরের তিলাওয়াত ধ্বনি, এ ধ্বনি তার হৃদয়ে শান্তির ছোঁয়া দিয়ে গেল। জেদ আর খেদের বশে বোন ও ভগ্নিপতিকে বেদম মার দিলেন, কোনো লাভই হয়নি নির্মম নির্যাতনে। বোন ফাতেমা ও সাইদ ঈমানি পরীক্ষায় কামিয়াবির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন।

তাদের হৃদয় কুরআনের মধুময় ছোঁয়ায় আজ ধন্য, কাজেই দেহের শত কষ্ট ব্যথা তাদের কাছে কিছুই না। ওমর রা: খুবই বিস্ময়াবিভূত হলেন, জানতে চাইলেন কিসের জাদুময়তা ও মধুময়তায় তারা এমন হলেন। বোন তাকে জানালেন দ্বীনের মূল কথা, শুনালেন কুরআনের সেই মধুময় সুর, যেটি শুনে ওমরের হৃদয় গলে গেল, চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল। খানিক সময়ও দেরি করেননি; কুরআনকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। রাসূল সা:-এর কাছে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’

আজানের মধুময় ও জাদুময় সুর অগণিত মানুষের হৃদয় এমনকি জীবনও পাল্টে দিয়েছে। রাসূল সা:-এর জমানায় ছোট্ট শিশু আবু মাহজুরা রা: আজানের সুরে আপ্লুত হয়ে নিজেকে পাল্টিয়ে ফেললেন, ঘটনার বর্ণনা, বিশ্বনবী কোনো এক যুদ্ধে যাওয়ার সময় এমন উপত্যকায় পৌঁছলেন, যেখানে কিছু শিশু-কিশোরের সাথে আবু মাহজুরা রা: বকরি চরাচ্ছিলেন। জোহরের সালাতের সময় হয়ে যায়। সেখানে তাঁবু ফেলা হয়। হজরত বেলাল রা: উচ্চস্বরে আজান দিতে লাগলেন। আবু মাহজুরা আজানের শব্দ শুনল এবং সে মনোযোগসহকারে আজানের পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। যে আজানের সুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তোলে। যদিও আবু মাহজুরা ঠাট্টা করে আজানের পুনরাবৃত্তি করছিল। আজান শেষ হতেই বিশ্বনবী হজরত আলী ও যুবাইর রা:-কে নির্দেশ দিলেন, কে আজান দিয়েছে। সে আজানদাতাকে নিয়ে আসো। তারা পাহাড়ের পেছন দিকে গিয়ে আজান নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপকারী বালকদেরকে রাসূলুল্লাহর কাছে নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে এই মাত্র আজান দিলো?

তখন তারা খুব লজ্জাবোধ করে একে অপরের দিকে তাকাল। কারণ সে তো ঠাট্টার স্বরে আজান দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ তখন একজন একজন করে আজান শুনতে লাগলেন এবং সর্বশেষ আবু মাহজুরা আজান দিলে তার আজান রাসূলুল্লাহ সা:-এর মনঃপূত হলো। রাসূলুল্লাহ বললেন, তুমি এই মাত্র আজান দিয়েছিলে? আবু মাহজুরা বলল- হ্যাঁ। তখন তিনি তাঁর বরকতময় হাত দিয়ে আবু মাহজুরার পাগড়ি খুলে তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক ফিহি, ওয়াহদিহি ইলাল ইসলাম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তাকে বরকত দাও এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দাও।’ আবু মাহজুরার ভাগ্য খুলে গেল, রাসূলুল্লাহর বকতময় হাতের স্পর্শ পেয়ে বলে উঠল-আশহাদু আললা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্নাকা রাসূলুল্লাহ। এ ঘটনায় প্রমাণিত হলো আজানের সুরে কেবল আবু মাহজুরার হৃদয় গলেনি; বরং আবু মাহজুরার সুরেলা কণ্ঠে স্বয়ং রাসূল সা:-এরও হৃদয় গলে গেল।

লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com