জেনোসাইড ’৭১ ফাউন্ডেশন, ইউএএস নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা দীঘদিন যাবৎ জেনোসাইড ভিকটিমদের স্মরণ, জেনোসাইড অপরাধ সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরী, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, একাওুরের বাঙ্গালী জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় এবং জেনোসাইড প্রতিরোধে কাজ করে আসছে। এই সংগঠন গতকাল ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক জেনোসাইড স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসের ৭ম বার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়কে জেনোসাইডে নিহতদের স্মরণ এবং জেনোসাইড প্রতিরোধের প্রত্যয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলো।
কর্মসূচির মধ্যে ১) বাঙালি জেনোসাইড স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে ‘বিশেষ কর্মসূচি’ শুরু উপলক্ষে সংবাদ সন্মেলন, ২) বাংলাদেশসহ বিশ্বময় ঘটে যাওয়া সকল জেনোসাইডে নিহতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জলন, ৩) জেনোসাইড উপর তথ্যচিত্র প্রদর্শন, ৪)’৭১ জেনোসাইড স্বীকৃতি বিষয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সন্মেলনসহ সকল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ প্রদীপ রঞ্জন কর। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন- ডঃ মনিরুল ইসলাম, কনস্যাল জেনারেল, নিউইয়ক।
আলোচক যারা ছিলেন- বিশিস্ট সাংবাদিক ফজলুর রহহমান, অধ্যাপিকা হোসনে-আরা, ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আলী সিদ্দিকী, এ্যাডভোকেট মোঃ বকতিয়ার আলী, রমেশ চন্দ্র নাথ, কামরুল আলম হিরা, বদিউজ্ঞামান পান্না, জালালউদ্দিন জলিল, অধ্যাপিকা মমতাজ শাহনাজ, একে চৌধূরী, খঃ জাহিদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, নুতন প্রজন্মের শুভ রহমান। সভায় বিশেষজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিল-স্বাধীন বাংলা বেতার শিল্পী রথীন্দ্র নাথ রায়, ডাঃ মাসুদুল হাসান, কণ্ঠশিল্পী রেজা রহমান ও কণ্ঠশিল্পী জলি কর প্রমূখ। অনুষ্ঠানের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ প্রদীপ রঞ্জন কর তার বক্তব্যে বলেন- একাত্তরের ৯ মাসে বাংলাদেশে যে নিসংশতা ও বর্বরতা সংগঠিত ঘটেছে তা যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, তা ‘জেনোসাইড’ হিসেবেই চিহ্নিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী যে জেনোসাইড চালিয়েছিল তার নির্মম সাক্ষীও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়া প্রকাশিত হয়েছে যার বিষদ বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়া প্রকাশিত এত সব মতামত ও প্রতিবেদনের পরও একাওুরের এতবড় জেনোসাইড আজও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেনি! জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যে শক্তিশালী উদ্যোগ আমাদের নেওয়া দরকার ছিল। আমরা তা নিতে পারি নাই। বিশ্ব সম্প্রদায়ও চরম অবহেলা দেখিছে বাংলাদেশের ক্ষেএে।আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই অনীহা ও ব্যর্থতার ফলে বিশ্বে একের পর এক জেনোসাইড অব্যাহত রয়েছে।যার সর্বশেষ সংযোজন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ যা জেনোসাইড এর শামিল। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ জেনোসাইড কনভেনশনে জেনোসাইড শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার পর ঘোষনায় বলা হয় …no more genocide…..!!! অথচ কনভেনশন প্রতিষ্ঠার ৭১ বছরে সারা “ বিশ্বে জেনোসাইড সংঘটিত হওয়ার ভয়ঙ্করভাবে দীর্ঘ।
তিনি আরো উল্লেখ করেন- একান্ন বছর পর ১৯৭১ সালের বাঙ্গালী জেনোসাইড বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে নৃশংস জেনোসাইড, যা প্রায় বিস্মৃত ছিল, তা মার্কিন কংগ্রেসে স্বীকৃতি পেতে উপস্থাপিত হয়েছে। এটাকে ইতিবাচক বিবেচনায় নিয়ে সামনে এগুতে চাই। আমরা “The Genocide’71 Foundation, USA” দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে কাজ করে আসছি। আমরা দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যানের H.RES. 1430, 117তম কংগ্রেস, 2য় অধিবেশনে বিলটি উপস্থাপন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সংশোধন স্বপক্ষে মার্কিন কংগ্রেসে এই বিলটি পাসের জন্য এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সহযোগিতার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ‘একাওুরের বাঙ্গালী জেনোসাইডের সারাংশ সম্বলিত একটি ডকুমেন্ট’ এর কপি ইউএস কংগ্রেসের ৪৩৫ জন সদস্য বরাবর পাঠিয়ে তাঁদের একাওুরের বাঙ্গালী জেনোসাইড সম্পর্কে সম্যক ধারনা দেওয়া প্রচেস্টা গ্রহন। এই ‘ডকুমেন্ট’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি অফ স্টেট ও অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর পাঠানো যাতে একাওুরের বাঙ্গালী জেনোসাইড স্বীকৃতি ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক থাকা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর খুনি সাজাপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরী ও সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আসারাফুজ্জামান খানকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কনস্যাল জেনারেল ডঃ মনিরুল ইসলাম আজকের দিনের তাৎপর্য উল্লেখ করে বলেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ এবং ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর সাবজনীন মানবধীকার সনদ গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘ প্রনয়ন করে জেনোসাইড কনভেনশন। এই কনভেনশন জেনোসাইড সজ্ঞায়িত হয় এবং জেনোসাইড শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত হয়।জেনোসাইড সজ্ঞায়িত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার ৬৭ বছর পর জাতিসংঘ ২০১৫ সনে ৬৯ তম সাধারন অধিবেশনে ৯ ডিসেম্বরকে স্বীকৃতি দিল আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধে ঘোষিত এই আন্তর্জাতিক দিবসটি এমনই এক দিনে ধার্য্য করা হয়েছে যে দিনটিতে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে গণহত্যা প্রতিরোধ এবং শাস্তি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল। তাই বিশেষ এই দিনটির এই দ্বৈত তাৎপর্য রয়েছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো জেনোসাইড ’৭১ ফাউণ্ডেশন, ইউএসএ জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত সকল জেনোসাইডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানান।
তিনি আরো বলেন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের চালানো জেনোসাইড জেনোসাইড বড় গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছিল, ‘রক্তই যদি কোনো জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মূল্য বলে বিবেচিত হয়, তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই অনেক বেশি মূল্য দিয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত এদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া চরম নরকযজ্ঞের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হয়নি। এ জেনোসাইড স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কাজ চলছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন- এ জেনোসাইডের একদিন স্বীকৃতি হবেই। তিনি উল্লেখ করে বলেন -জেনোসাইড স্বীকৃতি অর্জনে বিশ্বে যে সব দেশে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে সে সব দেশের কনস্যান জেনারেলদের সন্মনয়ে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে।