রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন

বন্ধুত্বের মূলনীতি : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৯৫ বার

‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’ শব্দদ্বয় আকারে ছোট্ট হলে এগুলোর উচ্চতা গগনচুম্বী, গভীরতা অতলস্পর্শী, ব্যাপ্তি বিশ্বময় এবং অনুরণন হৃদয় থেকে হৃদয়ে। ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’ সমার্থ শব্দ হলো ভ্রাতৃত্ব, প্রেম, হৃদ্যতা, সখ্য ইত্যাদি। শব্দদ্বয়ের আরবি প্রতিশব্দ হলো- ‘বেলায়াত’, ‘উখুওয়াত’ ‘মুওয়াদ্দাত’, ‘খুল্লাতুন’ ‘মুহাব্বত’ ‘হুব্বুন’ ইত্যাদি। অভিধানে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাকে সমার্থ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা উভয়টির উৎস স্বয়ং স্র্রষ্টা এবং ভিত্তি হলো বিশ^াস।

পরিভাষায় একাধিক মানুষের গভীর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। অন্য কথায়, দু’জনের গভীর আত্মিক সম্পর্কের অপর নাম বন্ধুত্ব। ভালোবাসার সংজ্ঞায় বলা হয়- মনঃপূত বস্তুর প্রতি হৃদয়ের আকর্ষণ। অন্যকথায়, কোনো কিছুর মধ্যে কোনো যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে তার প্রতি মনের আকর্ষণকে ভালোবাসা বলে। ভালোবাসার একান্ত দাবি হলো- যাকে ভালোবাসা হয় তার মনের চাহিদা অনুযায়ী চলা।

ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা এক অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত। কারণ বন্ধুত্ব ছাড়া ভালোবাসা হয় না, আবার ভালোবাসার স্পর্শহীন বন্ধুত্বও অস্তিত্বহীন।

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার গুরুত্ব
সহজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য : জগতে জীবন মাত্রই ভালো লাগা আছে, ভালোবাসা আছে। অন্যান্য জীবে বা জড়ে স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধি না থাকলেও তাদের পরস্পরের আচরণে ভালোবাসা সুস্পষ্ট। গবেষণার দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায়, সব কিছুর মধ্যেই ভালোবাসা নামক আকর্ষণ রয়েছে। মধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণে আসমান-জমিনকে স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। ভালোবাসার টানেই নদী ছুটে যায় সাগর পানে। আহ্নিক গতি হয়, জোয়ার-ভাটা হয়। পাখিরা গান গায়, ফুলেরা সৌরভ ছড়ায়। প্রজাপতি ছুটে চলে। জলপ্রপাত বয়ে যায়। ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর সব কিছু চলমান, বহমান ও আবর্তিত।

স্র্রষ্টার সেরা দান : ভালোবাসা আল্লাহর সেরা দান। তিনি যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন সে ব্যক্তির ভালোবাসা মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন। মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা থেকে ভালোবাসা, দয়া, মায়ার শিক্ষা লাভ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর ১০০টি রহমত আছে, যার মধ্য থেকে মাত্র একটি রহমত তিনি জিন, মানব, পশু ও কীটপতঙ্গের মধ্যে অবতীর্ণ করেছেন। ওই এক ভাগের কারণেই হিংস্র্র জন্তু তার সন্তানকে মায়া করে থাকে… (মুসলিম)।

অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক : ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো অবিচ্ছেদ্য ও চিরন্তন। মৃত্যুর পরও এ সম্পর্ক জারি থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই যাকে ভালোবাসে সে তার সাথী হবে’ (সহিহ বুখারি)।
বন্ধুত্বের পরকালীন প্রতিদান : হাদিসের বর্ণনা মোতাবেক যে সাত শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার ওপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার ওপরই চিরবচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয় (সহিহ বুখারি)।

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর মহান গুণ : কুরআন মাজিদ ও হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ কর্তৃক ভালোবাসার কথা উল্লেখ আছে। যেমন তিনি বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা বাকারাহ-১৯৫)।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর নিয়ামত : ‘আর তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)।

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অমূল্য সম্পদ : ‘তিনি তাদের অন্তরসমূহে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহব্বত পয়দা করে দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল আনফাল-৬৩)।

আল্লাহর ভালোবাসা লাভের মাধ্যম : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা মহব্বত করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা উপবেশন করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা খরচ করে এবং আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা পরিদর্শন করে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য ওয়াজিব (আবশ্যক) হয়ে গেছে’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)। আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্তির উপায় : হাদিসে কুদসিতে এসেছে- আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি পৃথিবীর অধিবাসীদের শাস্তি দিতে মনস্থ করি। অতঃপর যখন আমি আমার ঘর আবাদকারী, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের বন্ধুত্ব বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি ও অতি প্রত্যুষে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন আমি তাদের ওপর থেকে সেই শাস্তি সরিয়ে নিই (আমি নিবৃত্ত হই)’ (বায়হাকি)।

ভালোবাসা ঈমানের পূর্ণতার শর্ত : ভালোবাসার মাধ্যমে ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। যেমন আবু উমামাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়ে থাকে সে ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার (সুনানে আবু দাউদ)।

বন্ধুত্ব হলো নিরাপত্তার গ্যারান্টি : ‘যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে’ (সূরা আল ইউনুস-৬২)।

জান্নাত লাভের উপায় : আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরাই ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে।’
সর্বোত্তম প্রভাবক : বন্ধু হলো সর্বোত্তম প্রভাবক। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত কবি শেখ সাদী রহ:-এর কবিতাংশটি কতই না চমৎকার। তিনি লিখেছেন-

‘সংগীর গুণ পশিয়াছে মম মাঝে গো,
নইলে কাদায় সুবাতাস কি এতো পাইতে?’

(আগামীকাল সমাপ্য)
লেখক : সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com