রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামীকাল মঙ্গলবার। গতকাল রোববার মধ্যরাতে পর্দা নেমেছে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণার। বিজয়ী এবং বিজিতের মধ্যকার ভোটের ব্যবধানের হিসাবের ফারাক হবে কত, সেই হিসাবকষাকষি নিয়ে ব্যস্ত সবাই। জাতীয় পার্টির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি বলছে, এবারো বিজয়ী হবে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এবং পরাজিত প্রার্থীর সাথে ভোটের ফারাক হবে দেড় থেকে দুই লাখ, যা ২০১৭ সালে প্রায় লাখ ভোটের ব্যবধানে নৌকা প্রতীককে হারানোর রেকর্ডের দেড় থেকে দুই গুণ হবে বলে দাবি তাদের। তবে এবারের ভোট মেয়রের ক্ষেত্রে একতরফা উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন বলছে বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে ভোটের ফারাক অনেক হওয়া ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্য দিকে এই নির্বাচনে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আওয়ামী লীগের হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া দাবি করেছেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন এবার। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ভোটে কে নির্বচিত হবেন- নৌকা নাকি লাঙ্গল তা বলা মুশকিল।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর তৃতীয়বারের মতো কাল অনুষ্ঠিতব্য রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোটের মূল আকর্ষণ হলো মেয়র পদকে ঘিরে। ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বরের ভোটে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ৯৮ হাজার ৮০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন রংপুর সিটির প্রথম মেয়র নৌকা প্রতীকের মরহুম সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টুকে। এই নির্বাচনে মোস্তফা পেয়েছিলেন এক লাখ ৫৯ হাজার ৮২৪ ভোট। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঝন্টু পেয়েছিলেন ৬১ হাজার ৫৫৭ ভোট। মোস্তফা ঝন্টু ছাড়াও এই নির্বাচনে লড়েছিলেন পাঁচজন। তাদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৭৯১ ভোট। চতুর্থ অবস্থানে থাকা ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের আমিরুজ্জামান পিয়াল পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৭১৮ ভোট। এই নির্বাচনে পঞ্চম হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিরার। তিনি পেয়েছিলেন দুই হাজার ৩০৬ ভোট। আর এক হাজার ২৪৫ ভোট পেয়ে ষষ্ঠ হয়েছিলেন বাসদের মই প্রতীকের আব্দুল কুদ্দুস। আর সপ্তম হয়েছিলেন আম প্রতীকের সেলিম আখতার। তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৮০৭ ভোট। ওই নির্বাচন হয়েছিল একটিতে ইভিএম এবং ১৯২টি কেন্দ্রে ব্যালটে।
নির্বাচন বিশ্লেষক সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ২০১৭ সালের ভোটের হিসাবের অনেক কিছুই বদলে যাবে। যিনি বিজয়ী হবেন তার চেয়ে নিকটতমের ভোটের ব্যবধান দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনের চেয়েও বেশি হওয়ার কথা বলছেন তিনি।
জাতীয় পার্টির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব এস এম ইয়াসীর বলেন, প্রতিপক্ষ প্রার্থী নৌকার পক্ষে মাঠে তেমন একটা কেউ ছিলেন না। পক্ষান্তরে আমরা মূল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটাররাও মাঠে কাজ করেছি। সব প্রস্তুতি আমরা নির্বাচনের তিন মাস আগে সম্পন্ন করেছি। যার কারণে মাঠে যখন আমরা মাস্টার প্লø্যান ওয়েতে গেছি তখন ভোটাররাই আমাদের কর্মী হয়েছেন। সে কারণে আমরা মনে করছি এবারের জয়ে আমরা ২০১৭ সালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবো। আমরা দেড় থেকে দুই লাখ ভোট বেশি পেয়ে জিতব বলে আশা করছি। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, মানুষের ভালোবাসায় আমি অভিভূত। ২০১৭ সালে মরহুম মেয়র সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু ছিলেন একজন হেভিওয়েট ও নৌকার প্রার্থী। সেবার জনগণ তার থেকেও প্রায় এক লাখ ভোট আমাকে বেশি দিয়েছিল। এবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আগে প্রচারণায় ছিলেন না। যারা মাঠে ছিলেন, তাদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সে কারণে তারা মাঠে সেভাবে দাঁড়াতেই পারেননি। লাঙ্গলের পক্ষে ভোটের স্রোত তৈরি হয়েছে।
এ দিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি জানান, রংপুর মহানগরীতে আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন। মূল, অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলো সক্রিয়। আমরা সবাই মাঠে কাজ করছি। এখানে আগে প্রচারণা না থাকার বিষয়টি মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন এবং নৌকা প্রতীক। তা ছাড়া আমাদের প্রার্থীও হেভিওয়েট। তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। একজন সিনিয়র আইনজীবী। সুশিক্ষিত এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। উন্নয়নের জন্য মানুষ তাকে বেছে নিয়েছেন। আমরা মনে করি একটি শক্ত অবস্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হবো।
আওয়ামীলীগ প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া বলেন, রংপুরবাসীকে তিনি অনেক উন্নয়ন দিয়েছেন, যা দৃশ্যমান। তিনি আরো বলেন, আমি নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে একটি মাত্র অফিস করেছি। সেখান থেকেই কার্যক্রম চালাচ্ছি। এমনকি ছয়টি থানায়ও কোনো অফিস করিনি। আমি পুরো নগরীকে ভাগ করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছি। যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই মানুষের সাড়া পাচ্ছি। উন্নয়নের জন্য নরগরবাসী প্রধানমন্ত্রীর প্রতীক নৌকাকে ভোট দেবে এবং আমি বিজয়ী হবো ইনশা আল্লাহ।
রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর সূত্র জানিয়েছে, এবার ভোটার ও কেন্দ্র সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর ১৯৩টি কেন্দ্র থাকলেও ৩৬টি বেড়ে কেন্দ্র সংখ্যা হয়েছে ২২৯টি। এ ছাড়াও এবার স্থায়ী ভোট কক্ষ করা হয়েছে এক হাজার ৩৪৯টি এবং অস্থায়ী ভোট কক্ষ আছে ১৯৩টি। গত ২০১৭ সালের নির্বাচনের ভোটার সংখ্যার তুলনায় এবার ভোটার বেড়েছে ৩২ হাজার ৫৭৫ জন। গত বছর তিন লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৪ জন ভোটার থাকলেও এবার ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জনে। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন এবং মহিলা দুই লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন। রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর আরো জানিয়েছে, ভোট অনুষ্ঠানের জন্য একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার পাশাপাশি ১১ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ২২৯ জন প্রিজাইডিং অফিসার, এক হাজার ৩৪৯ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, দুই হাজার ৬৯৮ জন পোলিং অফিসার; মোট চার হাজার ২৭৬ জন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ প্রায় ১০ হাজার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো: আবদুল বাতেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত। প্রতিটি কেন্দ্রে যে পরিমাণ ইভিএম ব্যবহার হবে, তার দ্বিগুণ ইভিএম আমরা প্রস্তুত রেখিছি। যাতে কোনো ধরনের কোনোখানে ইভিএমে সমস্যা হলে সেটি কেন্দ্রে থাকা টেকনিক্যাল লোকজন ঠিক করে দেবে।
এই নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়াও হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলনের আমিরুজ্জামান পিয়াল, গোলাপ ফুল প্রতীকের খোরশেদ আলম, দেয়ালঘড়ি প্রতীকের খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল রাজু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের শফিয়ার রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লতিফুর রহমান মিলন এবং মেহেদী হাসান বণি মেয়র পদে এবং ১৭৮ জন সাধারণ এবং ৬৭ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।