মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৩ পূর্বাহ্ন

সিটি নির্বাচনে অসম্মানজনক ভোট : জাপায় ক্ষোভ অসন্তোষ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ২৫১ বার

কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন ও সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্টির অনেক যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাকে বাদ, অপরিচিত ও উপজেলা-জেলা পর্যায়ের নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই দেয়ার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল জাপাতে। কয়েক জায়গায় গণপদত্যাগেরও ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির জাপার মেয়র প্রার্থী লজ্জাজনক ভোট পাওয়ায় নেতাকর্মীদের ক্ষোভ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির নবম জাতীয় কাউন্সিলে জি এম কাদের চেয়ারম্যান ও মসিউর রহমান রাঙ্গা মহাসচিব নির্বাচিত হন। আর পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয় রওশন এরশাদকে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করা জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের একই সাথে বিরোধীদলীয় উপনেতা, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ। আর রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর পার্টিতে পদপদবি ও ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলেও একপর্যায়ে এভাবেই সমঝোতা হয় দেবর-ভাবীর মধ্যে।

নবম কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবলে জি এম কাদের ইতোমধ্যে পার্টির প্রেসিডিয়াম, উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নাম ঘোষণা করেছেন কয়েক ধাপে।

জাপা নেতাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, জি এম কাদের ঘোষিত এসব পদে যোগ্য লোকদের পাশাপাশি কিছু অযোগ্য, পার্টিতে অর্বাচীন ও জেলা-উপজেলার কিছু নেতাকে কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয়েছে। বাদ পড়েছেন জাপা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে যারা এরশাদের সাথে রাজনীতি করেছেন তাদের কেউ কেউ। এ ছাড়া এরশাদ ঘনিষ্ঠ কিছু তরুণ নেতানেত্রী এবং রওশন এরশাদ ঘনিষ্ঠ কিছু নেতাকেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই দেয়া হয়নি, আবার কেউ কেউ ঠাঁই পেলেও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এরশাদপুত্র সাদ এরশাদকে কো-চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জি এম কাদের ঘোষিত তালিকায় তাকে ৯ নম্বর যুগ্ম মহাসচিব রাখা হয়েছে। আর প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে যাদের নাম দিয়েছিলেন তাদের কাউকেই তা করা হয়নি।

সূত্র জানায়, জাপায় ৭৬টি সাংগঠনিক জেলা থাকলেও খোদ ঢাকা থেকেই কেন্দ্রে স্থান পেয়েছেন ৫১ জন। এ ছাড়া কমিটিতে নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও মানিকগঞ্জ জেলাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় গণপদতাগের ঘটনাও ঘটেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন না তাদেরও প্রমোশন দিয়ে বড় বড় পদে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা নেতা আব্দুস সাত্তার মোড়ল ও রূপগঞ্জ উপজেলা নেতা সাইফুল ইসলামকে করা হয়েছে সাংগঠনিক সম্পাদক। এ রকম সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থান দেয়া হয়েছে নাজিম উদ্দীন গেরিলা, শেখ মোহাম্মদ শান্ত, মমতাজ উদ্দিন, ড. আবদুল্লাহ ফাতাহ, ইব্রাহিম আজাদসহ অনেককে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সদস্য থেকে এক লাফে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে ওলিউল্লাহ চৌধুরী মাসুদকে। নুরুন নাহার বেগম, সালাউদ্দিন স্বপন, আবু সালেক ও সাব্বির আহমেদকে করা হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান। সম্পাদক থেকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে আহমদ শফি রুবেলকে। সদস্য থেকে সরাসরি উপদেষ্টা করা হয়েছে পনির উদ্দিন আহমেদকে। কেন্দ্রীয় কমিটির ফরমই সংগ্রহ না করেই শাহজাদী নাহিয়ান শান্তা, নুরুল ইসলাম মিলন, শওকত আকবর, এমদাদুল হক রুমনসহ অনেকে কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন বলে জানা গেছে।

বাদ দেয়া হয়েছে পার্টির অনেক ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী এম এ সাত্তার, প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খান, নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, মজিবুর রহমান সেন্টু, কাজী মামুনুর রশীদ, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, আতিকুর রহমান আতিক, মেজর (অব:) খালেদ আখতার, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল আমিন শানু, ড. আনোয়ার চৌধুরী জীবন, এইচ এম এন শফিকুর রহমান, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, নূরুল ইসলাম নুরু, যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি, ইলিয়াস উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবিদ আলী চৌধুরী, মোতাহারুল ইসলাম, মনোয়ার আলম, ইসহাক ভূঁইয়া, শেখ মাতলুব হোসেন লিয়া, হারুন অর রশিদ, এ কে এম আশরাফুজ্জামান খান, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন, অনন্যা হোসাইন মৌসুমী, শারমিন পারভীন লিজা, আবুল কাশেম সরকার, আব্দুল আওয়াল সেলিম, গোলাম মোস্তফা, মিজানুর রহমান, কবির সওদাগর, নিজাম উদ্দিন সরকার, রেজাউল করিম, শফিকুল ইসলাম দুলাল, মামুনুর রহমান, নেওয়াজ উদ্দিন ভূঁইয়া, হারুনুর রশীদ, কবির সওদাগর, ফারুক আহমেদসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।

এ নিয়ে পার্টির নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পার্টির এক উপদেষ্টা ও এক অতিরিক্ত মহাসচিবকে দায়ী করছেন। ক্ষুব্ধ অনেক নেতার দাবিÑ মরহুম এরশাদের সময়ও তাকে ঘিরে রেখে ভুল বুঝিয়ে বাণিজ্য করেছিল একটি মহল। বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা একজন উপদেষ্টা ও অতিরিক্ত মহাসচিবপদ বাণিজ্যসহ অনেক অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। ত্যাগী নেতাদের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে জাপায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে ভূমিকা রাখছেন এই চক্রটি।

জাপা থেকে বাদ পড়া মিজানুর রহমান দুলাল আক্ষেপ করে বলেন, পল্লীবন্ধু এরশাদের মৃত্যুর পর মনে করেছিলাম জি এম কাদেরের নেতৃত্বে পার্টি শক্তিশালী হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে কমিটি হবে। কিন্তু তা হয়নি। তার পাশে থাকা একটি সিন্ডিকেট টাকার বিনিময়ে পদ বাণিজ্য করছেন। যে কারণে জনপ্রিয় নেতারা মূল্যায়িত হননি।

এ কমিটি গঠন করাকে কেন্দ্র করে পদত্যাগকারী রাজশাহী মহানগর সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ডালিম বলেন, এরশাদের মৃত্যুর পর তার আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি জি এম কাদের। দলে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাও তার আছে বলে আমি মনে করি না। গত নির্বাচনে আম মার্কা নিয়ে যে ৫০ ভোটও পাননি তাকে করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান। আর আমরা ৩০ বছর সংগঠন করে সদস্য হতে পারি না।

এ দিকে শুধু কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন নিয়েই পার্টিতে অসন্তোষ বিরাজ করছে তাই নয়, সদ্য সমাপ্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনের মাত্র পাঁচ হাজার ৫৯৩ ভোট পাওয়া নিয়েও ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, জাপা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল। বলা হয়, জাপা তৃতীয় বৃহত্তর দল। অথচ সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন গণফ্রন্টের প্রার্থী আব্দুস সামাদ সুজন। তিনি মাছ প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট। আর চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আব্দুর রহমান পেয়েছেন লাঙলের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট। এটাকে লজ্জাস্কর হিসেবেই দেখছেন সাধারণ নেতাকর্মীরা। তৃণমূল কর্মীরা লাঙল প্রতীকে মাত্র পাঁচ হাজার ৫৯৩ ভোট পাওয়াকে অসম্মানজনক হিসেবেই দেখছেন।

তারা অভিযোগ করছেন, সাইফুদ্দিন মিলনকে মাঠে নামানো হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা তার পক্ষে সেভাবে নামেননি। এমনকি দক্ষিণ সিটি এলাকায় জাপার দুইজন এমপি থাকলেও তারাও ভূমিকা রাখেননি। জাপার কেন্দ্রীয় নেতা ও কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে আবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী পক্ষে সরাসরি কাজ করারও অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলছেন, আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবকে আরো সাবধান হতে হবে। তার আশপাশে থেকে যেন কেউ তাকে ভুল মেসেজ দিয়ে পার্টির ক্ষতি করতে না পারে, সে বিষয়টি তাকেই নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে একাধিকবার করে ফোন দেয়া হলেও কেউই রিসিভ করেননি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com