বড়দের মতো শিশুদেরও নানা কারণে মন খারাপ হয় এবং সেই মন খারাপ কখনো কখনো বিষণœতায় গড়ায়। আর বিষণ্ণতা যে একটি রোগ, এটা এখন কমবেশি আমরা জানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। আর বাংলাদেশে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৭৪ লাখেরও বেশি। তাদের মধ্যে শিশুরাও আছে। ‘জার্নাল অব সাইক্রিয়াট্রি’তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ১ শতাংশ শিশু বিষণ্ণতায় ভুগছে।
বিষণ্ণতা শিশুর বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে এবং এটা শিশুকে নানা রকম ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে, এমনকি বিষণ্ণতা শিশুকে আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। তাই শিশুদের মধ্যে বিষণœতার লক্ষণ দেখা দিলে সেটি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিতে হবে।
আপনার শিশু বিষণ্ণতায় ভুগছে কিনা, এটা কীভাবে বুঝবেন? এ বিষয়ে কথা হয় গ্রুমিং ফ্রেকসের সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সামিয়া আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আপনার শিশু বিষণ্ণতায় ভুগছে কিনা, এটা জানতে হলে প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে বিষণ্ণতা কী? বিষণ্ণতা হচ্ছে স্বাস্থ্যগত একটি মানসিক সমস্যা। এটা মূলত আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। এতে আক্রান্ত হলে শিশুর দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপন, কর্মতৎপরতা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে। এটা কখনো কখনো স্বল্পমেয়াদি এবং কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।
বিষণ্ণতার লক্ষণ
যে কোনো কারণেই শিশুর মন খারাপ হতে পারে। তাই বলে মন খারাপ হলেই শিশু বিষণ্ণতায় ভুগছে, এটা ভাবার কারণ নেই। মন ভালো-খারাপ হওয়া একটা স্বাভাবিক অবস্থা। তা হলে কীভাবে বুঝবেন আপনার শিশু বিষণ্ণতায় ভুগছে? ফারহানা আলম বলেন, কোনো কারণে শিশুর মন খারাপ হলে ৩-৪ দিন বা এক সপ্তাহ থাকতে পারে। এর বেশি হলে তখন সেটি বিষণ্ণতার দিকে অগ্রসর হয়। এ ছাড়া শিশুর মধ্যে যদি হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ করেন। যদি দেখেন সে অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে গেছে, কারও সঙ্গে মিশছে না, কথা কম বলছে, পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে; তা হলে আপনি শিশুর দিকে নজর দিন। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে অনেক সময় শিশু মেজাজি ও অস্থির আচরণও করে। সে ঠিকমতো খেতে চায় না, গোসল করতে চায় না। সে একা থাকতে চায়, ঠিক সময়ে ঘুমায় না আবার অনেক সময় দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমায়। এই লক্ষণগুলো মোটেও স্বাভাবিক নয়। শিশুর মধ্যে এমন কিছু দেখলে অবশ্যই গুরুত্ব দিন। প্রথমে মা-বাবা নিজেরাই শিশুর সঙ্গে কথা বলুন, শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন, জানতে চান তার সমস্যা কী। প্রয়োজন হলে সাইক্রিয়াট্রিস্ট বা মানসিক চিকিৎসকের পরামর্ম নিন। কাউন্সেল করান।
বিষণ্ণতার কারণ
নানা কারণে শিশু বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ হচ্ছে মানসিক নির্যাতন, স্কুলে সহিংসতার শিকার, স্কুলে কেউ অপমানজনক আচরণ করলে, বন্ধুরা কোনো কারণে বুলি করলে, খুব কাছের বা ঘনিষ্ঠ কারও মৃত্যু হলে, পোষা প্রাণী হারিয়ে বা মারা গেলে, প্রেমে পড়ে বলতে না পারলে বা ব্রেকআপ হলে, পারিবারিক অশান্তি, মা-বাবার বিচ্ছেদ, পারিবারিক পরিবেশ, ঘনিষ্ঠ কারও দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ইত্যাদি। এর বাইরেও কিছু কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যাও শিশুর মনের ওপর চাপ তৈরি করে।
শিশুর পাশে থাকুন
শিশুর এ সমস্যা অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য। শিশুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলুন। শিশুরা অনেক সময় মনে করে, তার সমস্যার কথা বললে মা-বাবা বিশ্বাস করবেন না। উল্টো তাকেই দোষী করবেন। তাই শিশুর মনে আস্থা তৈরি করুন। খেয়াল করুন সে কী বলতে চায়। আনেক সময় মুখে বলে না, আচরণে প্রকাশ করে। যেমন- নিকট আত্মীয় দ্বারা শিশু কোনো রকম হয়রানির শিকার হলে তাকে সে অ্যাভয়েড করে, তার সামনে যেতে চায় না। এই আচরণগুলো অ্যালামিং। খেয়াল করুন, কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। আজকাল ইন্টারনেট ব্যবহার করেও শিশু-কিশোররা নানা রকম সমস্যায় জড়িয়ে যায়। তার পর হয় ব্ল্যাকমেইলের শিকার। অনেক কিশোরী সাইবার হয়রানির শিকার হয়। কিশোররাও নানা রকম ফাঁদে পড়তে পারে। অতিরিক্ত গেমে আসক্তি, কিশোর গ্যাং দ্বারা ব্ল্যাকমেইলের শিকার, ব্রেকআপ ইত্যাদি। তাই শিশুদের সঙ্গে খুব সহজভাবে মিশে তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনুন। ওদের বুঝিয়ে বলুন জীবনে এমন নানা ঘটনা ঘটতে পারে। এতে হাল ছেড়ে না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো শেখান। শিশুর বন্ধু হন, তার কথা শুনুন। সব সময় শিশুর ওপর চাপিয়ে না দিয়ে, সে কী চায় শুনুন এবং সম্ভব হলে শিশুর চাওয়ার মূল্যায়ন করুন।