আম আদমি পার্টির (আপ) জয়ী প্রার্থী আমানাতুল্লা খানের জনপ্রিয়তা নয়। দলে তার ‘বস’ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্যারিশমা নয়। ভারতের রাজধানী দিল্লির ওখলা বিধানসভা কেন্দ্রে গত বারের থেকেও বেশি ব্যবধানে বিজেপির হার নিশ্চিত করার আসল কারিগর নাকি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ!
সেই ওখলা, যার অন্তর্ভুক্ত শাহিন বাগে প্রায় দু’মাস ধরে রাস্তায় বসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন মহিলারা। আর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় পুলিশি তাণ্ডবের পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাও প্রায় একই সময় বন্ধ একই প্রতিবাদে। অভিযোগ, প্রচারে ধর্মীয় বিভাজন উস্কে দিতে দুই আন্দোলনকেই নাগাড়ে নিশানা করেছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা।
২১ রাউন্ড গণনার শেষে আমানাতুল্লার জয় যখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, তখনই মহারানি বাগের গণনাকেন্দ্রের সামনে কান পাতা দায়। তার সামনে ঢোল আর ব্যান্ডপার্টির বাজনার সঙ্গে উদ্দাম নাচ সমর্থকদের। এরই মধ্যে গলা চড়িয়ে শোয়েব খান বললেন, ‘‘বিজেপির ভোট বেশি পাওয়ার আশা এই কেন্দ্রে কখনো ছিল না। কিন্তু বিপক্ষে ভোট ভাগাভাগির যে টুকু সম্ভাবনা ছিল, তা রুখে দিয়েছেন অমিত শাহই!’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিবাসীকে ডাক দিয়েছিলেন, ‘‘এত জোরে ইভিএমের বোতাম টিপুন, যাতে শাহিন বাগের কারেন্ট লাগে।’’ ওই ভিড়ে শোয়েব-সহ অনেকেরই দাবি, ‘‘আমানাতুল্লা আগাগোড়া জামিয়া মিলিয়া ও শাহিন বাগের পাশে থাকলেও তার দল যে ভাবে গত দু’মাস সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাতে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। অনেকে ঝুঁকছিলেন কংগ্রেসের দিকে। অমিতের ওই কথার পরে অনেক ভোট ফিরে এসেছে ঝাঁটায় (আপের নির্বাচনী প্রতীক)।’’ গোটা ভোটপর্বে অমিত শাহের শাহিন বাগ-ময় প্রচারের পরেও আপ-এর বিপুল জয়ের পরে তাই সোশ্যাল মিডিয়া দিল্লিকে ‘শাহ-হীন বাগ’ বলে কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই।
তবে এই ‘কৃতিত্ব’ শুধু অমিতকে দিতে নারাজ ওখলা। আবিদ খান, খুররম, ওয়াসিমেরা বলছিলেন, ‘‘কোনো মন্ত্রী আমাদের ‘গদ্দার’ ঠাউরে বুকে গুলি চালানোর স্লোগান দিয়েছেন। কোনো নেতা টেনে এনেছেন বিরিয়ানির কথা! এর পরেও মানুষ রাগ উগরে দেবেন না?’’ যাদের বিরুদ্ধে কামান দেগে বিজেপি কেজরিওয়ালের দুর্গ দখলে নেমেছিল, এই ফলের পরে কী বলছেন সেই শাহিন বাগের ‘দাদিরা’?
কিছুটি না! কারণ, শাহিন বাগের মঞ্চে মঙ্গলবার সকলের মুখে কুলুপ। অনেকের মুখ কাপড়ে বাঁধা। সামনে গান্ধীর ছবির পাশে লেখা ‘মৌন ব্রত’। উদ্যোক্তাদের দাবি, গতকাল জামিয়ার ছাত্রদের উপরে যে ভাবে পুলিশ ফের হামলা চালিয়েছে, এই নীরব প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, এ দিনের নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের সঙ্গে নিজেদের আন্দোলনকে জড়াতে চান না শাহিন বাগের প্রতিবাদীরা। চান না এই বার্তা দিতেও যে, বিজেপির হারে কিংবা কেজরিওয়ালের জয়ে তাঁরা খুশি। সেই কারণে এই কৌশলী সিদ্ধান্ত।
তা বলে ওখলা বিধানসভা এলাকার কোথাও কি আর খুশির ঝিলিক নেই? বিলক্ষণ আছে। মহারানি বাগের রাস্তায় দাঁড়িয়ে লেইকুল্লা খান বলছিলেন, ‘‘গণনা শুরুর ঘণ্টা খানেকের মাথায় যখন বিজেপি প্রার্থী অল্প কিছু ভোটে এগিয়ে গিয়েছিলেন, দম যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো।’’
এই বিধানসভায় ভোটারদের প্রায় ৪০% মুসলিম। ২০১৫ সালেও জয়ী প্রার্থীর নাম ছিল আমানাতুল্লা। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিজেপির এই ব্রহ্ম সিংহ। ব্যবধান ছিল প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার ভোটের। এ বার সেই ব্যবধান বেড়ে পৌঁছেছে ৭১,৮২৭ ভোটে। দুপুর তিনটা-সাড়ে তিনটা নাগাদও অবশ্য তা ঘোরাফেরা করছিল ৮২-৮৫ হাজারের আশেপাশে।
শাহিন বাগের মঞ্চ এ দিন মৌন। কিন্তু ওই এলাকার বাজার, জামিয়ার সামনের গেট সমেত বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়ল আনন্দ আর স্বস্তির কোলাজ। ধর্মের নামে এই দুই আন্দোলনের বিরোধী প্রচার করে যে ভোটে ফায়দা তুলতে পারেনি বিজেপি, তা স্বস্তি দিয়েছে আন্দোলনকারীদের। কোথাও ‘জিত মুবারক’ বলে পরিচিতকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন মধ্যবয়স্ক। কোথাও আলোচনা, ‘উল্টে শাহিন বাগই শক দিয়েছে বিজেপিকে’। রাস্তার মোড়ে কেউ বলছেন, ‘২০০ নেতা-মন্ত্রীকে নামিয়েও জেতা গেল না?’ আবার জয়ের মিষ্টি পান মুখে পুরে প্রবীণ সাক্সেনার দাবি, ‘‘আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পানি-বিদ্যুৎ চাই। হিন্দু-মুসলিমে বাঁটোয়ারা নয়।’’
শাহিন বাগের লঙ্গরে এক মহিলা হাতে ধরা মাইকে বার বার বলছিলেন, ‘‘প্রতি প্লেটে দু’টি করে পুরি (লুচি) দিন প্রথমে। চারটি নয়। কোনো খাবার যাতে নষ্ট না-হয়।’’
হাত ত্রিশেক দূরে দাঁড়িয়ে পাশের বৃদ্ধ বললেন, ‘‘ভোটই নষ্ট করিনি, তো খাবার।’’
প্রশ্ন করলাম, ‘‘নাম কি আপনার?’’ উত্তর এলো, ‘‘জেনে কী হবে? লিখে নিন, শাহিন বাগের কেজরিওয়াল!’’
অভিমান ধুয়ে সাফ?
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা