এম হাফিজউদ্দিন খান
বিএনপির রাজনীতি নিয়ে এখন নতুন করে বলার মতো কিছু দেখছি না। রাজনীতির চর্চা ও গণতন্ত্র নিয়ে তারা নানাভাবে কোণঠাসা হয়ে আছে। এ ছাড়া মামলার ভারে জর্জরিত আছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে। জাতীয় নির্বাচনে তারা ভালো করেনি। এখন বিভাগীয় শহরে যেসব নির্বাচন হচ্ছে, তারা নির্বাচনে ভালো করতে পারছে না। আন্দোলন করে কোনো দাবি আদায়েও সমর্থ হচ্ছে না। বড় কোনো ইস্যু সামনে এনে তা বাস্তবায়ন করা—সেসব নিয়েও কিছু হচ্ছে না। পিছিয়ে পড়ছে। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া আটক আছেন বহুদিন হয়ে গেল। বয়স্ক একজন মানুষ, বিএনপি কোনোভাবেই তাঁকে বের করে আনতে পারল না। নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে তাঁকে মুক্ত করার; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
বিএনপি সংগঠন নিয়ে বসে নেই। তবে সনাতন পদ্ধতিতে ভাবলে কোনো কাজ হবে না। হলে এত দিনে কিছু একটা হতে পারত। তারা এত দিন ধরে ঘরে ও বাইরে সরব আছে, আন্দোলন করছে, বিবৃতি দিচ্ছে; কিন্তু সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। কাজেই এখন প্রথম ও শেষ কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে বিএনপিকে দাঁড়াতে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রবল। এসব কাটিয়ে উঠতে হবে। তাদের চেয়ারপারসন মাঠে নেই, ঘরেও নেই। সব জায়গায় তিনি অনুপস্থিত। কোনো ছোট বা বড় বিএনপি নেতাই প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে আসতে চান না। ভয় পান। এর কারণও আছে। এটি আমার কাছে অত্যন্ত বড় সংকট বলে মনে হয়।
এখানে একটি কথা বলা দরকার—খালেদা জিয়ার কনভিকশন হয়েছে কোর্টে। যদিও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল সে বিষয়ে; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কথা হচ্ছে, টাকাটা তাঁর অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তা আত্মসাৎ করেননি। এটাকে আত্মসাৎ কোনোভাবে বলা যায় না। কিন্তু যেহেতু তিনি আটক হয়েছেন সুনির্দিষ্ট কারণে এবং তাঁর মুক্তি পাওয়া ও না পাওয়ার বিষয়টি আদালতের, কাজেই এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা কঠিন।
আমরা এটুকু বলতে পারি, তিনি অসুস্থ। তাঁর বয়সও হয়েছে। কোনো একটা অঘটন ঘটতে পারে, সেটা বলা যায় না। তিনি যে অসুস্থ, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তা না হলে কেন তাঁকে হাসপাতালে রাখা হবে। সাধারণভাবে নানা কথা বলা যায়—তিনি এ দেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। আমি আইনের লোক নই এবং আইনজ্ঞও না, তবে যা দেখছি, আইনিভাবে তাঁর মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। তাই মানবিকভাবে বিবেচনা করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া যায়। মুক্তি দেওয়া উচিত।
এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে, সরকারপক্ষ বলছে এটা আইন বা আদালতের বিষয়। আমাদের কিছু করার নেই। সরকার এটাও বলেছে, প্যারোলে মুক্তি চাইলে তারা বিবেচনা করে দেখবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মুশকিল হচ্ছে, প্যারোলে মুক্তি নিতে হলে দোষ স্বীকার করে নিতে হবে। খালেদা জিয়া বা বিএনপি এ বিষয়ে কোনো দোষ স্বীকার করে নেবে বলে মনে হয় না। তবে ফৌজদারি আইনে নানা বিবেচনায় জামিন দেওয়া যায়। কোর্ট এটা ইচ্ছা করলেই দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপিল করলে, কোর্ট যদি রাজি হন এবং সরকার যদি বাধা না দেয়, তাহলে জামিন হতে পারে। এতে কোনো সমস্যা দেখি না।
আমার নিজের বিবেচনায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া উচিত। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। অসুস্থতা আগেও ছিল। কিন্তু এখন আরো বেড়েছে। তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। আবার তাঁর বয়স বাড়ছে, সেটাও একটা সমস্যা। উন্নত চিকিৎসার জন্য হলেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া যায় বলে মনে করি।
সরকার যেটা বলছে, সেটা অস্বীকার করা যায় না। ক্রিমিনাল ল অনুসারে তাঁর অপরাধ জাস্টিফাই করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোর্ট কী সিদ্ধান্ত দেন, তা বলতে পারব না। কোর্টের সিদ্ধান্ত অকাট্য। তবে মানবিক বিবেচনায় তাঁকে জামিন দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
একটা কথা বলা হয়, আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা সমানভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয় বলে আমার মনে হয় না। একটা বাণিজ্যিক ব্যাংকে যে দুর্নীতি হয়েছে, এমডি এত টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন, এত টাকা পেলেন কোথায়? এমনকি ব্যাংকের এক সাবেক শীর্ষকর্তা কত টকা খরচ করেছেন, নয়ছয় করেছেন—সব নিজে বলেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিটও হয়নি। এটা আমাকে খুব অবাক করেছে। এভাবে বহু নজির দেওয়া সম্ভব। এরপর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর এত বছর পার হয়ে গেল, কোনো কিছুই হলো না। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় এখন পর্যন্ত সেভাবে কোনো কিছু হয়নি। এতে যেটা মনে হয়, আইনের সঠিক প্রয়োগ সব জায়গায় সঠিকভাবে হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ মামলাজট আছে। আর আইন সংশোধনের কথা শোনা যায়, সেসব নিয়েও খুব একটা কাজ হয়েছে বলে জানা নেই। যেকোনো সমস্যা ও বড় ধরনের বিষয়ে আইনের কথা বলা হয়; কিন্তু সব সময় সেভাবে না মানারও কথা শোনা যায়।
এ রকম নানা কিছু বিবেচনা করলে খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া যায়। মানবিকভাবে তাঁকে জামিন দিলে কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। খালেদা জিয়াকে জামিন দিলে কোনো ক্ষতি হবে সরকারের, সে রকম কোনো কিছু আমি মনে করি না। তাঁকে জামিন দেওয়া উচিত। জামিন দিতে হবে—এটাও ন্যায্য দাবি বিএনপির। কিন্তু মানবিকভাবে তাঁকে জামিন দেওয়ার বিষয়টা ভাবাই হয় না। তিনি একজন বয়স্ক মানুষ, পরিবারের কেউ নেই দেশে। জেলের ভেতরেও তিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। তাঁর নানা ধরনের অসুখও রয়েছে। আর তাঁর মতো মানুষকে জামিন দিলে বিদেশিরা আপত্তি করবে বলে মনে হয় না, বরং এ বিষয়ে বিদেশিরা খুশি হবে।
খালেদা জিয়ার নামে নানা ধরনের মামলা আছে। মামলা থেকে তাঁকে সরাসরি রেহাই না দেওয়া গেলে বিভিন্নভাবেই তাঁকে জামিন দেওয়া যায়। তবে মানবিকভাবে জামিন দিলে কোনো সমস্যা দেখি না। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সমান নয় সব সময়। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের যে ঘাটতি, এর পেছনে কোথায় ত্রুটি আছে—যাঁরা আইন নিয়ে কাজ করেন তাঁদের ত্রুটি, নাকি অদক্ষতা, কেন আইন সব সময় সমান হয় না—এসব নিয়েও আমি ভাবি। আমাকে ভাবায়। কোথায় ঘাটতি আছে, সে কারণে আইন সব সময় একইভাবে কাজ করে না?
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। কাজেই মূল রাজনীতির বাইরে দেশে যে একটি বিরোধী দল থাকতে হবে, এটা সবার জানা আছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল জরুরি। এখন পর্যন্ত বিএনপির বাইরে আমি আর কোনো বড় দল তো দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বিএনপি নানাভাবে জর্জরিত। মামলার ভার, সাংগঠনিক দুর্বলতা, ঐক্যবদ্ধ না থাকার প্রবণতা—এসব সমস্যা আছে। মামলার ভারে যেমন বিএনপি জর্জরিত, তেমনি দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে জর্জরিত। এসব নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা ভাবেন কি না, গুরুত্ব দেন কি না বলতে পারছি না। দলকে নতুন কিছু করতে হলে এবং উঠে দাঁড়াতে হলে সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করতে হবে। নেত্রীকে মুক্ত করতে হবে। যেকোনো সামাজিক ও জাতীয় ইস্যুতে আরো সক্রিয় হতে হবে। এর বাইরে বিএনপির জন্য আর কোনো বিকল্প দেখছি না।
শেষ কথা আর কী বলার আছে। আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কাজেই তাঁকে মানবিকভাবে মুক্তি দেওয়া উচিত। আবার একই সঙ্গে বিএনপির টিকে থাকতে হলে তাদের ন্যায্য দাবি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনও চালিয়ে যেতে হবে। তাদের থেমে গেলে চলবে না। এমনিতে তো তারা মামলার ভারে জর্জরিত। কাজেই নানাভাবে তাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে। দলকে চাঙ্গা রাখতে হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
অনুলিখন : মাসউদ আহমাদ