সরকার সর্বশেষ খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি খোলা চিনির দাম ১০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে বেশিরভাগ দোকানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে ভোক্তাদের ২৬ থেকে ৩১ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে। তার পরও অনেক দোকানে মিলছে না। উধাও হয়ে গেছে প্যাকেট চিনি। এমন পরিস্থিতিতে চিনি ব্যবহৃত হয় এমন পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ছে।
মালিবাগ বাজারে চিনির দাম শুনে বিরক্ত বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মোস্তাক আহমেদ। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ঈদের আগেও যে চিনি ১২০-১২৫ টাকায় পাওয়া গেছে, তা এখন ১৩০-১৩৫ টাকা হয়ে গেছে। তার পরও অনেক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। যা পরিস্থিতি তাতে চিনির স্বাদ এখন তিতা ঠেকছে।’
বাজারটির বেশ কয়েকটি দোকানে চিনি বিক্রি হচ্ছে না। বিপ্লব স্টোরের খুচরা বিক্রেতা মো. সোলায়মান বলেন, ‘বাড়তি দামের এ চিনি বিক্রি করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই বিক্রি বন্ধ রেখেছি। কারণ চিনি কেনার সময় পাকা রসিদ দেওয়া হয় না। তাই মোবাইল কোর্ট এলে এত বেশি দামে চিনি বিক্রির দায়ে বিপদে পড়তে হবে।’
গতকালের (মঙ্গলবার) পাইকারি বাজারে চিনির বস্তার (৫০ কেজি) দর ৬ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত ছিল বলে জানান কদমতলী এলাকার সাদ্দাম মার্কেট বাজারের মিলন জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মিলন হোসেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে চিনির বস্তা ৫ হাজার ৮০০ টাকায় কেনা গেছে। কিছুদিন আগেও ১২৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে পেরেছি। এখন ১৩৫ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে গত ৬ এপ্রিল সরকার পরিশোধিত প্রতি কেজি খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১০৪ টাকা এবং পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির দাম ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাজারে এ দামে চিনি মিলছে না। রোজার ঈদের পর উল্টো দাম ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
প্রতিদিনের বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) বলছে, গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা পর্যন্ত। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, এক মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং এক বছরে বেড়েছে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ।
চিনির দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন শরবত বিক্রেতা মো. সোহেলও। যাত্রাবাড়ী মোড়ের এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘লোকসান এড়াতে শরবতের দাম গ্লাসপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়ানো ছাড়া উপায় দেখছি না। আবার দাম বাড়ালে বিক্রিও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’ সোহেলের মতো বিপাকে পড়েছেন আশপাশের টং দোকানের চা বিক্রেতারাও। দাম বাড়ানোর কথা ভাবছেন তারাও। এ ছাড়া বেকারি পণ্য ও বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর দামেও চিনির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকেই অতিরিক্ত দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেই আমাদের কিনতে হচ্ছে ১২৩ টাকা। সরবরাহও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর প্রভাবে পাইকারি ও খুচরায় দাম বেড়ে গেছে।
মিলমালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারেই চিনিতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে চিনি আমদানি নিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন তারা। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বলেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারদরে চিনি আমদানি করলে দেশের খুচরা বাজারে দাম অনেক বেড়ে যাবে। বিষয়টি সরকারের নজরে আনার জন্য এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আগের শুল্ক সুবিধার সুফলই ভোক্তারা পায়নি, নতুন করে সুবিধা দেওয়া হলে তা ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ খাতে এখনো হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়েও চিনি আমদানি করা যেতে পারে।