রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:২০ পূর্বাহ্ন

‘শান্তিকামী’ জাপান কেন নতুন করে অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে?

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩
  • ৪৬ বার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় এবং তারপর হিরোশিমা নাগাসাকিতে আমেরিকার ফেলা পারমাণবিক বোমায় হাঁটুর ওপর বসে পড়েছিল এক সময়ের পরাক্রমশালী ঔপনিবেশিক শক্তি জাপান।

আমেরিকার চাপে যুদ্ধের পর তাদের নতুন সংবিধানে একটি ধারা (আর্টিকেল নাইন) যোগ করে জাপানকে বলতে হয়েছিল যে তারা আর কখনো যুদ্ধ করবে না এবং কোনো সেনাবাহিনী রাখবে না।

পরবর্তীতে জাপানি রাজনীতিকদের অনেকেই খোলাখুলি বলেছেন সংবিধানের ওই নবম ধারা জাপানকে দুর্বল করেছে। কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদ একে উল্টে দেয়ার সাহস করেননি।

কিন্তু এই শতকের প্রথম দিক থেকে জাপানি নেতারা সেই সাহস দেখাতে শুরু করেন। শুরু করেছিলেন জুনিচিরো কোইজুমি। এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন শিনজো আবে। আর এখন তার উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা কোনো রাখঢাক করছেন না।

কিশিদার সময় জাপান প্রচুর অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কিনেছে এবং কিনছে। বিমানবাহী একাধিক জাহাজ সংস্কার করছে। শত শত মার্কিন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার অর্ডার দিয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে ৩১১ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিশিদা, যা সেদেশের জিডিপির দুই শতাংশ, এবং আগের পাঁচ বছরের চাইতে ৫০ শতাংশ বেশি।

অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, জাপান শেষ পর্যন্ত তাদের সেই যুদ্ধ-বিরোধী, শান্তিকামী দেশের ইমেজ পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু ঠিক কেন জাপান এখন তাদের প্রতিরক্ষা নিয়ে এত তৎপর হয়ে উঠেছে?

চীন-জাপান সম্পর্কের গবেষক ও বিশ্লেষক এবং কুয়ালালামপুরে মালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে জাপান বেশ কিছুকাল ধরেই উদ্বিগ্ন। ইউক্রেনে রুশ হামলা জাপানের সেই উদ্বেগ আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।

‘ইউক্রেনে রুশ হামলার পর জাপান বিচলিত যে রাশিয়া যদি এমনটি করতে পারে তাহলে চীনও তাইওয়ান আক্রমণ করতে পারে। তাদের ভয় যদি চীন তা করে এবং তাইওয়ান চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে চীনের নৌ-বাহিনীর যে শক্তি তাকে আটকানোর আর কোনো উপায় থাকবে না,’ বলেন ড. মাহমুদ আলী।

চীনা ভীতি
জাপানের ভয় তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধ বাঁধলে সেই যুদ্ধে আমেরিকা জড়িয়ে পড়বে এবং তাদেরও জড়িয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তাইওয়ানের খুব কাছেই জাপানের সর্ব দক্ষিণের কিছু দ্বীপ অবস্থিত। সেগুলোতে কি চীন হাত দেবে? ওকিনাওয়া দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি কি চীনের টার্গেট হতে পারে? এসব প্রশ্ন নিয়ে জাপানে বেশ কয়েক বছর ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। পাশাপাশি, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়েও জাপান গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

এমনিতেই ঐতিহাসিক কারণে চীনের প্রতি জাপানের ভয়ভীতি রয়েছে। ১৮৯৪ সাল থেকে চীন ও জাপানের মধ্যে বৈরিতা চলছে। ষাটের দশকের শেষ দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন। সেই সূত্রে পরের ২০ বছর জাপানও চীনের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়।

কিন্তু ১৯৯৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আবারো বৈরি ভাবাপন্ন দৃষ্টি নিয়ে দেখতে শুরু করলে জাপানও সেই পথ নেয়। ২০০৭ সালে শিনজো আবে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে সেই বৈরিতা ভিন্ন মাত্রা পায়।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা আরো কট্টরপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। চীন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হবে জেনেও তিনি এমনকি সম্প্রতি ন্যাটো সামরিক জোটকে টোকিওতে একটি মিশন খোলারও অনুমতি দিয়েছেন।

নতুন করে জাপানের এই সামরিকীকরণ সে দেশের মানুষ কতটা সমর্থন করছে?

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং রাজনীতির অধ্যাপক জাজুটো সুজুকি বিবিসিকে বলেছেন ‘জাপানের ভেতরে একটি সাধারণ বোধ তৈরি হয়েছে যে দেশের চারপাশটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।’

সে কারণেই সাম্প্রতিক কিছু জনমত জরিপ বলছে, দেশের সিংহভাগ মানুষ প্রতিরক্ষা জোরদার করার পক্ষে। ৯০ শতাংশ জাপানি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতা আরো ঘনিষ্ঠ করার পক্ষে। ৫১ শতাংশ সংবিধানের নবম ধারা সংশোধনের পক্ষে।

ফলে কিশিদা এবং তার দল এলডিপির ওপর তেমন চাপ নেই। জাপানকে দিনকে দিন অস্ত্রে সজ্জিত করা হচ্ছে, এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আয়ত্তে রাখার আমেরিকার যে নীতি তা বাস্তবায়নে জাপান এখন প্রধান একটি ভূমিকা রাখছে ।

সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ‘আবের উদ্যোগেই কোয়াড নামে চীনের বিরুদ্ধে একটি মিত্র কোয়ালিশন গড়ে তোলা হয়। সেই প্রচেষ্টা ক্রমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এবং জাপানই তার নেতৃত্বে রয়েছে।’

বাংলাদেশকে অস্ত্র দেবে জাপান
তাদের এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে এমনকি বাংলাদেশেও চীনের প্রভাব কমাতে উদ্যোগী হয়েছে জাপান। বাংলাদেশের সাথেও সামরিক সহযোগিতার একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাচ্ছে তারা।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন কক্সবাজারে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে জাপানের অর্থায়নের পেছনে আসলে তাদের সেই ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যই কাজ করছে।

ঢাকায় নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব) এএনএম মুনিরউজ্জামান বলেন, কাগজে-কলমে মাতারবাড়ি প্রকল্পকে জাপান এখনো তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসাবে দেখায়নি, কিন্তু সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

‘জাপান বলছে, মাতারবাড়ি প্রকল্প তাদের বিগবি (বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট) কর্মসূচির অংশ। এটি তাদের একটি কৌশলগত পরিকল্পনা। মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে তারা এ অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলবে এবং বিভিন্ন পণ্যের একটি সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠা করবে । চীনের ওপর আমদানি নির্ভরতা কমানোই এর প্রধান উদ্দেশ্য বলে মনে হয়,’ বলেন জে. মনিরুজ্জামান।

জাপানি প্রধানমন্ত্রী কিশিদা মার্চে যখন ভারতে যান সেসময় স্পষ্টভাবেই এই ইঙ্গিত দেন।

তবে মুনিরউজ্জামান বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রকল্পটি জাপানের নিরাপত্তা কৌশলের অংশ কিনা তা এখনো সরাসরি বলা না গেলেও দেশটি এখন বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্কের জন্য উন্মুখ। তিনি বলেন, এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টোকিও সফরের সময় দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে দুই দেশের সম্পর্ক একটি ‘স্ট্রাটেজিক অংশিদারিত্বের’ সম্পর্কে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

‘লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে জাপানকে সবসময় বাংলাদেশের একটি অর্থনৈতিক অংশীদার, উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এবার যৌথ ঘোষণায় নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা খাতে বড়মাপের সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে,’ বলেন মুনিরুজ্জামান।

তিনি জানান, এপ্রিলের ওই যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী জাপান ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে যৌথ মহড়া হবে, সিনিয়র কম্যান্ডার পর্যায়ে সফর হবে, সামরিক প্রশিক্ষণ হবে, দুই দেশের দূতাবাসে প্রথমবারের মত সামরিক শাখা খোলা হবে। এছাড়া বাংলাদেশের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা সমন্বয় করতে জাপান ঢাকায় একটি অফিস করবে।

‘এমনকি এই প্রথমবার জাপান বাংলাদেশকে সমরাস্ত্র দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা খাতে বড় ধরণের সহযোগিতার সূচনা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে।’

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও আমেরিকাকে কেন্দ্র করে যে দলাদলি বা মেরুকরণ চলছে তাতে বাংলাদেশ কি তাহলে কোনো পক্ষ নিয়ে ফেলছে?

‘প্রকাশ্যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নেয়নি। তবে যৌথ ঘোষণায় এমন কিছু এসেছে যা বাংলাদেশের জন্য একদম নতুন কিছু পদক্ষেপ। আপনি বলতে পারেন একটা ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার মাত্রা বুঝতে আরো অপেক্ষা করতে হবে,’ বলেন মুনিরুজ্জামান।

এতদিন ধরে জাপান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি ছিল অর্থনীতি, বাণিজ্য- বিনিয়োগ। সেই সম্পর্কে হঠাৎ করে সামরিক আঙ্গিক যোগ হওয়া কিছুটা বিস্ময়কর। বোঝাই যাচ্ছে অন্য অনেক শক্তিধর দেশের মত জাপানও এখন বিনিয়োগকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের পথ নিচ্ছে।

বাংলাদেশ নজরে কেন?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশ যেন বিশেষ করে বন্দর এবং অন্যান্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগের জন্য চীনের দ্বারস্থ না হয়।

এমনকি চীন বিরোধী সহযোগিতা জোট কোয়াডে ঢুকতে বাংলাদেশকে চাপাচাপি করা হয়েছে বলেও বিভিন্ন সময় খবর বেরিয়েছে।

কেন বাংলাদেশকে পক্ষে টানার এই চেষ্টা? বাংলাদেশকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে জাপান বা আমেরিকা?

‘এর কারণ বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের ঠিক উত্তরে, এর একদিকে দক্ষিণ এশিয়া, অন্যদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া,’ বলেন ড. মাহমুদ আলী।

কিন্তু জাপান বা আমেরিকার মত শক্তিধর ধনী দেশের কাছ থেকে এই বিশেষ নজর কি বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে যাবে? অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশের সুবিধা হবে? নাকি বিপত্তি তৈরি করবে?

জেনারেল মুনিরুজ্জামান মনে করেন, কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার যে নীতি বাংলাদেশ বহুদিন ধরে অনুসরণ করছে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

‘আমরা এতদিন যে ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছিলাম, তা চাপের মুখে পড়েছে। দু’দিক থেকেই এমন সব প্রস্তাবনা আসছে যেগুলোর সাথে যুক্ত হলে একপক্ষে চলে যেতে হবে। কৌশলগত সেই স্বাধীনতা ধরে রাখতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবে আমি সন্দিহান কতদিন আমরা তা পারব,’ বলেন জেনারেল মুনিরুজ্জামান।

অবকাঠামোর জন্য বাংলাদেশের এখনো প্রচুর সহজলভ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। তৈরি পোশাক ও অন্যান্য কিছু পণ্যের জন্য তাদের পশ্চিমা বাজার প্রয়োজন। সেই পুঁজির জন্য বাংলাদেশ চীনের কাছেও গেছে, জাপানের কাছেও গেছে, পশ্চিমাদের কাছেও গেছে।

কিন্তু বর্তমানে শক্তিধর দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক দলাদলি যেভাবে বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশের মত পূঁজির অভাবগ্রস্ত, কূটনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলো জটিল সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।

সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com