বালাসোর জেলা হাসপাতালের বাইরে বসে থাকা এক পুরুষ তার হাতের মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলেন। হঠাৎ হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।
একটু তফাতে দাঁড়িয়ে লোকটির জ্যাঠতুতো ভাই সূর্যকান্ত বেরা। তিনি জানালেন, এই মাত্র মোবাইল ফোনের মেসেজে তার জেঠিমার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন তারা। মা হারানো ভাইকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন, বুঝতে পারছেন না তিনি।
তিনটি ট্রেনের ভয়াবহ সংঘর্ষে শত শত আহত-নিহত মানুষদের যেসব হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, বালাসোর তার একটি। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের এই শহরটি এখন আহত রোগীদের ভিড়ে উপচে পড়ছে। কারণ ঘটনাস্থলের কাছে হওয়ায় এখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষকে আনা হয়েছে।
সূর্যকান্ত বেরা এবং তার জ্যাঠতুতো ভাই তার জেঠিমা এবং নানীর সন্ধানে এই হাসপাতালেই ছুটে এসেছিলেন।
দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহের জন্য আমি যখন কলিকাতা থেকে এই বালাসোর হাসপাতালে এসে পৌঁছাই, তখন দুপুর হয়ে গেছে। হাসপাতালে শত শত মানুষ এসে ভিড় করছেন, তাদের আহত বা নিখোঁজ পরিজনদের সন্ধানে।
সূর্যকান্ত এবং তার জ্যাঠতুতো ভাইর সাথে আমার যখন দেখা হলো, তখনো তারা হন্যে হয়ে খুঁজছেন পরিবারের দুই নিখোঁজ সদস্যকে।
সূর্যকান্ত জানালেন, তারা বালাসোরেরই বাসিন্দা। তার জেঠিমা এবং নানী কটকে গিয়েছিলেন চিকিৎসার ওষুধ আনার জন্য। গতকাল ইয়াশভান্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসে ফিরছিলেন, যেটি রাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুর্ঘটনার খবর শুনে সাথে সাথে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাত সাড়ে ১০টায় নানীকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পান। কিন্তু জেঠিমার কোনো সন্ধান পাচ্ছিলেন না।
নিখোঁজ জেঠিমার ছবি এবং কী শাড়ি পরে তিনি ভ্রমণ করছিলেন, সেসবের বিস্তারিত বিবরণ তারা শেয়ার করেছিলেন সব আত্মীয়-পরিজন বন্ধু বান্ধবের সাথে। সেই বিবরণ দেখে মাত্রই একটু আগে এক বন্ধু মেসেজ করে জানিয়েছেন, এই হাসপাতালেই তার লাশ আছে। মেসেজটি আসার পর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সূর্যকান্তের ভাই।
বালাসোরের এই হাসপাতাল এখন এরকম আরো বহু মানুষের প্রিয়জন হারানোর কান্নায় ভারী হয়ে আছে।
যাদের এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের রাখা হয়েছে মূলত দু’টি ভবনে- অর্থোপেডিক এবং সার্জারি বিভাগে।
হাসপাতালের যে ভবনটিতে পোস্টমর্টেম বিভাগ, সেখানেও বহু মানুষের ভিড়। নিহতদের লাশ গত রাত থেকে সেখানে এনে রাখা হচ্ছে। লাশ শনাক্ত করতে অনেকে সেখানে ছুটছেন। বহু লাশ এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে আহতদের অবস্থা দেখার সুযোগ হয়েছিল। দুর্ঘটনায় কারো হাত ভেঙেছে, কারো পা। অনেকের মুখে-চোখে-মাথায় আঘাতের ক্ষত-চিহ্ন।
আহত কয়েকজন যাত্রী বললেন, যখন দুর্ঘটনায় ট্রেনের বগি ছিটকে পড়ল, তখন তারা নিচে চাপা পড়েছিলেন।
এত আহত মানুষের চিকিৎসার জন্য এরকম একটি সাধারণ মানের জেলা হাসপাতালে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই, আছে রক্তের সঙ্কট।
রক্তদানের আবেদনের পর গত রাতে বহু মানুষ রক্ত দান করতে এখানে লাইনে দাঁড়ান। বহু মানুষ চলে আসেন নিজেদের উদ্যোগে, তারা রাতভর এখানে ছিলেন।
এত বড় একটা ট্রেন দুর্ঘটনার শত শত রোগী সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন এখানকার ডাক্তার এবং নার্সরা। তাদের সহায়তা করতে এখন বাইরে থেকে আরো ডাক্তার-নার্স নিয়ে আসা হয়েছে।
এই দুর্যোগে বহু মানুষ স্ব-উদ্যোগে যার যার মতো করে আহত-নিহত মানুষদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মানুষের মধ্যে খাবার বিলি করছেন।
হাসপাতালে ছুটে আসছেন মন্ত্রী-এমপিরা। কিন্তু এই বিশাল দুর্যোগের চাপ নিতে পারছে না জেলা পর্যায়ের এই ছোট্ট হাসপাতাল। অনেকে তাদের স্বজনদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কিছু অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে তাদের রোগীদের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেছে সরকারী ব্যবস্থায়। সূত্র : বিবিসি