রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

লাওহে মাহফুজ : আল্লাহর সংরক্ষণ ফলক

এনবিডি নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩
  • ৬০ বার

‘লাওহে মাহফুজ’ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সংরক্ষণ ফলক। কুরআন ও হাদিসে এই আরবি শব্দটির প্রয়োগ বিদ্যমান। লাওহে মাহফুজের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসিরবিদ আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, ‘এটি উচ্চ পরিষদ কর্তৃক সংযোজন, বিয়োজন, বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪৯৭, ৪৯৮)

দুনিয়ায় সবধরনের সৃষ্টির পরিকল্পনা, সৃষ্টিরাজির আকৃতি প্রকৃতি, কুলমাখলুকাতের প্রকৃত সংখ্যা, সৃষ্টিকুলের বয়সসীমা, মাখলুকাতের সব প্রজাতির নমুনা, রিজিকের সবধরনের উপাদান, আসমানি গ্রন্থগুলোর মূললিপি ও লিখনী, শব্দ ও সুর, তাকদিরের সব লিখন, মানুষের পরিণতি ও প্রতিদান, জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের তালিকা, সর্বোপরি আল্লাহর ইলমের সবকিছুই লাওহে মাহফুজে অকল্পনীয় ও অতুলনীয় নিরাপত্তায় সুসংরক্ষিত। ‘লাওহে মাহফুজ’ আরশে আজিমের মধ্যে অবস্থিত। আল্লাহপাক প্রথম সৃষ্ট মাখলুক কলমের সাহায্যে লাওহে মাহফুজে কিতাবের ছত্রের মতো লিখিত আঙ্গিকে প্রতিটি লাইন করে সব ‘ইলাহি তথ্য’ বা ‘কুদরতি তথ্য’ সংরক্ষণ করেন। আল্লাহর সংরক্ষণ ফলক লাওহে মাহফুজের আকৃতি অতি দামি লাল ইয়াকুত পাথরের মতো উজ্জ্বল রঙের। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে একটি আছার বর্ণিত রয়েছে, হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘লাওহে মাহফুজ লাল ইয়াকুত পাথরের তৈরি। তার উপরাংশ আরশের সাথে সংযুক্ত, নিম্নাংশ একজন সম্মানিত ফেরেশতার ওপর। আল্লাহর কিতাব নূর, কলম নূর দিয়ে তৈরি। তিনি প্রতিদিন লাওহে মাহফুজের প্রতি ৩৬০ বার দৃষ্টিপাত করেন। হজরত আনাস রা: বলেন, লাওহে মাহফুজ হজরত ইসরাফিলের পিঠের উপর। হজরত মাকাতিল রহ: বলেন, লাওহে মাহফুজ আরশের ডান দিকে অবস্থিত। (তাফসিরে কুরতুবি, পৃষ্ঠা-২৯৮, খণ্ড-১৯) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, লাওহে মাহফুজের দৈর্ঘ্য আসমান-জমিনের সমান প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমের সমান। আর তা নির্মিত হয়েছে সাদা মণিমুক্তা দিয়ে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪৯৮)

লাওহে মাহফুজ আল্লাহর সৃষ্ট খুবই দামি মাখলুক। আল্লাহপাক সৃষ্টির সূচনালগ্নে এটিকে সৃষ্টি করেছেন। এটি এমন এক সংরক্ষণ ফলক যার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই, বিচ্যুতি নেই, পরিবর্তন নেই, পরিবর্ধন নেই এমনকি পরিমার্জনও নেই। যেটির স্পর্শ করা কোনো মানব কিংবা দানব, জিন কিংবা ফেরেশতা কারোরই পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি কিংবা গবেষণাও লাওহে মাহফুজের সম্পর্কে আদৌ কোনো তথ্য আনয়ন করার ন্যূনতম ক্ষমতা দেখাতে পারেনি। পৃথিবীর সব গবেষক, বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ প্রচেষ্টা লাওহে মাহফুজের কোনো একটি তথ্যের সন্ধান বের করতে সম্ভব হয়নি এবং কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না। কেননা, লাওহে মাহফুজ নামক ফলক আল্লাহর জিম্মায় সুসংরক্ষিত। আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, ‘লাওহে মাহফুজ এমনভাবে পরিপূর্ণ, যাতে কোনো ঘাটতি নেই বাড়তিও নেই, পরিবর্তন নেই বিকৃতি কিংবা বিচ্যুতিও নেই।’

হজরত মুকাতিল বলেন, ‘লাওহে মাহফুজ আরশের ডান দিকে অবস্থিত; মূলত এটি কিতাবসদৃশ যাতে আল্লাহপাক কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। সবকিছুই উল্লেখ করেছেন।’ ইবনে আবিল ইজ্জ বলেন, ‘লাওহে মাহফুজে মূলত সৃষ্টিরাজির তাকদিরের যাবতীয় লিখনী সুসংরক্ষিত।’ এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন- ‘তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ জানেন যা কিছু আকাশে ও ভূমণ্ডলে আছে এসব কিতাবে লিখিত আছে। এটি আল্লাহর কাছে সহজ।’ (সূরা হজ-৭০) তিনি আরো বলেন- ‘আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন ভেদ নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে না আছে।’ (সূরা নামল-৭০) তিনি আরো বলেন- ‘আর তোমার পরোয়ারদিগার থেকে গোপন থাকে না একটি কণাও, না জমিনের এবং না আসমানের। না এর চেয়ে ক্ষুদ্র কোনো কিছু আছে, না বড় যা এই প্রকৃষ্ট কিতাবে নেই।’ (সূরা ইউনুস-৬১) তিনি আরো বলেন- ‘আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীতিগুলো লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।’ (সূরা ইয়াসিন-১২) হাদিসে এসেছে, আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি বিষয়ে তাঁর সৃষ্ট জীবের জন্য চূড়ান্তভাবে (তাকদিরে) লিখে দিয়ে নির্ধারিত করে রেখেছেন- ১. তার আয়ুষ্কাল (জীবনকাল); ২. তার আমাল (কর্ম); ৩. তার অবস্থান বা মৃত্যুস্থান; ৪. তার চলাফেরা (গতিবিধি) এবং ৫. এবং তার রিজিক (জীবিকা)।’ (মুসনাদে আহমাদ-২০৭২৯)

আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের ওপর অবতীর্ণ সব আসমানি কিতাব ও সহিফা লাওহে মাহফুজে সুসংরক্ষিত। আল্লাহপাক বলেন- ‘বরং এটি মহান কুরআন, লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ।’ (সূরা বুরুজ : ২১-২২) লাওহে মাহফুজ মাখলুকাতের দৃষ্টিসীমা, অর্জিত ইলম ও কল্পিত ধারণার অগোচরে। আল্লাহপাকের সংরক্ষিত সংরক্ষণ ফলক লাওহে মাহফুজ তাঁরই ইচ্ছায় সুনিয়ন্ত্রিত। লাওহে মাহফুজের লিপিবদ্ধ কিতাবখানি অত্যন্ত গোপন আধারে বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয় এটি সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক গোপন কিতাবে।’ (সূরা ওয়াকিয়াহ : ৭৭-৭৮) বনি আদমের সব কৃতকর্ম যা কিরামান কাতেবিন নামক ফেরেশতাদ্বয় প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করেন সেগুলোও আল্লাহপাকের ইচ্ছায় তাঁরই বিশেষ সংরক্ষণ ফলকে সংরক্ষিত হয়। আল্লাহপাক বলেন- ‘আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে- হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি, সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সূরা কাহাফ-৪৯) আল্লাহপাক তাঁর মনোনীত নবী ও রাসূল এমনকি শহীদদের আমলনামা যেটি তাঁর খাস সংরক্ষণ ফলকে সংরক্ষিত সেটিও যথাযথভাবে উপস্থাপন করবেন। আল্লাহপাক বলেন- ‘পৃথিবী তার পালনকর্তার নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা স্থাপন করা হবে, পয়গম্বররা ও সাক্ষীদেরকে আনা হবে এবং সবার মধ্যে ন্যায়বিচার করা হবে- তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সূরা জুুমার-৬৯)

লাওহে মাহফুজের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশবিশেষ। লাওহে মাহফুজ ‘গায়েব’-এর পর্যায়ভুক্ত। সব মুসলমানের ওপর ইসলাম নির্দেশিত ‘গায়েব’ বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা অত্যাবশ্যক, কেননা এটি মু’মিন ও মু’কিনিন (দৃঢ়বিশ্বাসী) ব্যক্তির মূল ধর্মীয় বিশ্বাস।

লেখক :

  • মো: আবদুল গনী শিব্বীর

মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com