মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের মধ্যে যাদের আল্লাহ তাআলা ঈমানের মতো অমূল্য সম্পদ দান করেছেন তাদের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। তারা আল্লাহর প্রিয়ভাজন।
মানুষের মর্যাদা : মহানবী (সা.) বলেছেন, ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে আরজ করেন, হে প্রভু! আপনি মানবজাতিকে দুনিয়া দান করেছেন, তারা পানাহার করে, বস্ত্র পরিধান করে, আর আমরা সদা আপনার প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করছি; আমরা পানাহার করি না, কোনো কৌতুক করি না, তাই মানবজাতিকে যেমনি দুনিয়া দান করেছেন, তেমনিভাবে আমাদের আখিরাত দান করুন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যুত্তরে বলেন, যাদের আমি নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছি, তাদের সমতুল্য এমন কাউকে করব না, যাদের কুন (হও) দ্বারা সৃষ্টি করেছি (আল-মুজামুল আওসাত, সপ্তম খণ্ড, পৃ-৯৯)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি অবশ্যই মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি এবং স্থলে ও সমুদ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছি…।’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ৭০)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তিনি সে মহান সত্তা, যিনি মানবজাতির কল্যাণে পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৯)
মুমিনের মর্যাদা : একজন মুমিন আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত দামি। মুমিন নিজেও বোঝে না তার কত দাম। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, জায়েদ ইবন হারাম (রা.) নামে এক গ্রাম্য সাহাবি মহানবী (সা.)-কে গ্রামের জিনিস উপহার দিতেন। তিনিও তাকে শহরের জিনিস উপহার দিতেন। মহানবী (সা.) উপহাস করে বলতেন, জায়েদ আমার গ্রাম্য বন্ধু, আর আমি তার শহুরে বন্ধু। মহানবী (সা.) তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। জায়েদ (রা.) ছিলেন খুবই কৃষ্ণকায় ব্যক্তি। একদা জায়েদ (রা.) মদিনার বাজারে গ্রামের জিনিসপত্র বিক্রি করছিলেন, এমতাবস্থায় মহানবী (সা.) জায়েদ (রা)-কে পেছন দিক দিয়ে জাপটে ধরেন। জায়েদ (রা.) মহানবী (সা.)-কে চিনতে না পেরে বলেন, তুমি কে? আমাকে ছেড়ে দাও। জায়েদ চেহারা ফিরিয়ে মহানবী (সা.)-কে দেখতে পেয়ে স্বীয় দেহকে প্রিয় নবী (সা.)-এর দেহ মোবারকের সঙ্গে লাগানোর চেষ্টা করেন। মহানবী (সা.) বলতে লাগলেন, এ গোলামকে কে কিনবে? আমি একে বিক্রি করব। জায়েদ বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে সস্তায় বিক্রি করতে হবে। কারণ আমি কালো-কুৎসিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জায়েদ! তুমি সস্তা নও, তোমার রবের কাছে তুমি অনেক দামি। (তিরমিজি, মিশকাত পৃষ্ঠা-৪১৬)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে সাধারণ ফেরেশতার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান। (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৪)
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, সাধারণ মুমিন আল্লাহর কাছে কিছু কিছু ফেরেশতা থেকে সম্মানী, অর্থাৎ মুমিনমাত্রই বিশেষ বিশেষ ফেরেশতা থেকে আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানী। (তাফসিরে ইবন কাসির, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৩)
এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না ও ভাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৮, বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, পৃষ্ঠা-৯৩, আল মুগনি-১/৪৭৯, বুলুগুল মুরাম, পৃষ্ঠা-৩৪৪, তিরমিজি : ৪/৩২৫)
আয়না দ্বারা মানুষ স্বীয় চেহারা দেখে। চেহারায় কোনো দোষ-ত্রুটি দেখতে পেলে আস্তে করে তা দূর করে, যাতে চেহারায় কোনো আঘাত না লাগে। মুমিন যখন তার স্বামীর মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখতে পায় তখন নীরবে তা দূর করার চেষ্টা করে। অন্য কাউকে তা জানতে দেয় না।
পরস্পর তিনটি কাজ হারাম
যেহেতু এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই, সেহেতু তিনটি কাজ তাদের জন্য হারাম।
১. উপহাস করা : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনরা কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে।’
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, উপহাস বলা হয় কোনো ব্যক্তিকে হেয় ও অপমান করার জন্য তার কোনো দোষ এমনভাবে উল্লেখ করা, যাতে শ্রোতারা হাসতে থাকে। কোরআনের ভাষায় তা হারাম।
২. কাউকে দোষারোপ করা : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা নিজেদের দোষ বের করো না। অর্থাৎ তোমরা অন্যদের দোষ বের করলে, তারাও তোমাদের দোষ বের করবে। কারণ দোষ থেকে কোনো মানুষ মুক্ত নয়। জনৈক মনীষী বলেছেন, তোমার মধ্যেও দোষ আছে, আর মানুষেরও চক্ষু আছে। তারা কিন্তু তোমার দোষ দেখে। তুমি কারো দোষ বের করলে সেও তোমার দোষ বের করবে। অতএব, মুসলমান ভাইয়ের দুর্নাম করা নিজেরই দুর্নাম করার নামান্তর। (মাআরিফুল কোরআন, সুরা : হুজরাত)।
৩. মন্দ নামে ডাকা : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না।’ কাউকে মন্দ নামে যেমন—খোঁড়া, খঞ্জ, অন্ধ ইত্যাদি নামে ডাকা নিষিদ্ধ। এরূপ মন্দ নামে ডাকা হারাম। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে এমন গুনাহ দ্বারা লজ্জা দেয়, যা থেকে সে তাওবা করেছে, তাকে সেই গুনাহে লিপ্ত করে ইহকালে ও পরকালে লাঞ্ছিত করার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছেন। (কুরতুবি)
মহানবী (সা.) বলেছেন, মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি এবং তার সঙ্গে যুদ্ধ করা কুফরি। (সহিহ বুখারি : ৬০৪৪, সহিহ মুসলিম : ৬৩)
জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমার থেকে তিনটি বিষয়ে বাইআত নিয়েছেন। ১. নামাজ কায়েম করা, ২. জাকাত প্রদান করা, ৩. প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করা। (সহিহ বুখারি : ৫৫)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪, তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৭)
অন্যত্র বলেন, ঈমানদারদের সঙ্গে অন্য ঈমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সঙ্গে মাথার সম্পর্ক। সে ঈমানদারদের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট তেমনি অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে (মুসনাদ আহমদ : ৫/৩৪০)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে অপমানিত করে না এবং তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে না (মুয়াত্তা : ২/৯০৭ মুসনাদ আহমদ : ২/২৭৭)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, মুমিনরা পারস্পরিক একটি প্রাচীরের ইটের মতো, একে অন্য থেকে শক্তি অর্জন করে (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৬৪৬, মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৫)
বিশ্বনবী (সা.) অন্যত্র বলেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে তার ভাইয়ের প্রতি অত্যাচার করে না। আবার তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় না। (বুখারি, হাদিস : ২৪৪২)
অন্যত্র রয়েছে, কোনো মুসলমান যখন তার ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, তখন ফেরেশতা ‘আমিন’ বলে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৩২)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, আল্লাহ স্বীয় বান্দার সহযোগিতায় ততক্ষণ থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে। (মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)
মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, তোমরা পারস্পরিক হিংসা কোরো না, পারস্পরিক শত্রুতা পোষণ কোরো না, গোয়েন্দাগিরি কোরো না, কারো দোষ তালাশ কোরো না, একে অন্যের অগ্রবর্তী হবে না, ভাই ভাই হিসেবে আল্লাহর বান্দা হও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৪, মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৩)
অন্য হাদিসে রয়েছে, মুমিনরা একটি দেহের মতো, দেহের একটি অঙ্গে ব্যথা অনুভব হলে সমস্ত অঙ্গের ব্যথা অনুভব হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১, মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৬, মুসনাদ আহমদ : ৪/২৬৮)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।