গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভিয়েতনামে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত গোপন তথ্য ফাঁস করে দেশটির ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি’র খেতাব পাওয়া ড্যানিয়েল এলসবার্গ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
৯২ বছর বয়সী এই যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের কেনসিংটন শহরে মারা গেছেন। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি।
১৯৫৫ সালে ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রপন্থীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পরে সেই যুদ্ধ পার্শ্ববর্তী লাওস এবং কম্বোডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।
ভিয়েতনামের উত্তরাংশ ছিল কমিউনিস্টদের অধীনে, অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছিল গণতন্ত্রপন্থীদের হাতে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই যুদ্ধে একসময় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নও জড়িয়ে পড়ে।
তবে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা যে অনেক বেশি ছিল, তার জানা যায় ‘পেন্টাগন পেপার্স’ ফাঁসের পর। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তর পেন্টাগন থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত ৭ হাজার পৃষ্ঠার গোপন নথি ফাঁস করেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ, যা পরে পরিচিতি পায় পেন্টাগন পেপার্স নামে।
ড্যানিয়েল এলসবার্গ ‘পেন্টাগন পেপার্স’ ফাঁসের আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিশ্বাস ছিল— ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহায়তাপুষ্ট তথাকথিত গণতন্ত্রপন্থীরাই জয়ী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ, সংবাদমাধ্যম এবং অন্যান্য প্রচার-প্রচারণাযন্ত্রও সেই বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে সদা তৎপর ছিল।
কিন্তু আমেরিকানদিরে এই ধারণা বড় ধরনের ধাক্কা দেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ, ১৯৬৯ সালে পেন্টাগন পেপার্স ফাঁসের মাধ্যমে। তার এই কাণ্ডের পরই জানা যায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে দেশের জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচার করছিল যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
এবং তারপর থেকেই ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আসার দাবি যুক্তরাষ্ট্রে উঠতে থাকে জোরে শোরে।
এজন্য অবশ্য এলসবার্গকে মূল্যও দিতে হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদামাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে গোপন সেসব প্রতিরক্ষা তথ্য প্রকাশের পর তাকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই সঙ্গে দেশবিরোধী তৎপরতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।
সেই মামলা গড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এবং তাতে জয়ী হন ড্যানিয়েল। সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ড্যানিয়েল এলসবার্গ কোনো অপরাধ করেননি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারেরর দায়ের করা এই মামলা ভুল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
১৯৩১ সালে মিশিগানে জন্ম নেওয়া ড্যানিয়েল এলসবার্গ প্রথম জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন বাহিনীর একজন সেনাসদস্য ছিলেন। সেনা বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেছেন এলসবার্গ।
পেশাগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষক হলেও অন্যান্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন এলসবার্গ। বাইরের দেশে মার্কিন সেনা পাঠানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে সারাজীবন যুক্ত ছিলেন পরমাণু অস্ত্র ও যুদ্ধবিরোধী প্রচারাভিযানে।
‘১৯৬৯ সালে যখন আমি পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস করলাম, সে সময় অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম যে এই ঘটনার দায়ে বাকি জীবন হয়তো আমাকে কারাগারে কাটাতে হবে।’
‘কিন্তু আমার মনে হয়েছিল— একটি অন্যায় যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে হলে যদি আমাকে সারা জীবন কারাগারে কাটাতে হয়, তবে তা ই সই।’
পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস প্রসঙ্গে নিজের ডায়রির এক জায়গায় এ কথাগুলো লিখেছেন ড্যানিয়েলস এলসবার্গ। – সূত্র : এএফপি