‘ব্রিকস’ উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট। বর্তমানে ব্রিকসভুক্ত দেশের মোট জনসংখ্যা ৩৪২ কোটি এবং মোট আয়তন ৪০ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এবং মোট আয়তনের ৩০ শতাংশ। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের আশার কথা শুনিয়েছিল এ জোট। তবে এখন ব্রিকস পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে একটি পৃথক কূটনৈতিক ফোরাম ও উন্নয়ন অর্থায়ন নিয়ে ভাবছে। মূলত উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ ঊর্ধ্বমুখী। সেই সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ওপর এসব দেশের বেশ প্রভাব রয়েছে।
ব্রিকস দেশগুলো মনে করে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা ব্যবস্থার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। নিষেধাজ্ঞা, বয়কট ইত্যাদি জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। তাই ব্রিকস তার সদস্য ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার প্রসারে জোর দিয়েছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক জিডিপির মোট অবদানে ব্রিকস জি-সেভেন অর্থনীতিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সূত্র মতে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রিকসের অবদান ছিল ৩১.৫ শতাংশ বা ২৬.০৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান এবং একই সময় এফডিএই প্রবাহ ও স্টক ছিল ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাণিজ্যে তাদের অবদান ৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার যা মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১৮ শতাংশ। একটি প্রক্ষেপণে অনুমান করা হয় যে, ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রিকস দেশগুলোর অবদান ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে।
ব্রিকসের সম্ভাবনা দেখে আরো ২০টি দেশ সদস্যপদ লাভের আবেদন করেছে যা বাস্তবায়িত হলে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরবর্তীকালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ব্রিকসের প্রাসঙ্গিকতা আরো বেড়েছে। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে নিজস্ব অবস্থান দৃঢ়করণ এবং গ্রুপ অব সেভেনভুক্ত (জি-সেভেন) উন্নত দেশগুলোর বিকল্প মডেল দাঁড় করানোর লক্ষ্যও রয়েছে ব্রিকসের।
ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)
পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা ব্যবস্থার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বের হয়ে আসার জন্য ব্রিকস ২০১৫ সালে এনডিবি প্রতিষ্ঠা করে। ২০২১ সালে বাংলাদেশকে এনডিবিতে নতুন সদস্যপদ দিয়েছে যা দেশের উন্নয়নে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ হবে। এনডিবির বর্তমান প্রধান ব্যাংকটির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে মার্কিন ডলার থেকে সরে আসার কথা বলেন। সদস্য দেশগুলোকে দেয়া ঋণের অন্তত ৩০ শতাংশ স্থানীয় মুদ্রায় দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহার হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালের মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়িয়ে চলেছে। এতে উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে, ফলে তাদের পক্ষে আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এতে দেশগুলো থেকে পুঁজিও চলে যাচ্ছে; বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। এই বাস্তবতায়, এনডিবি বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থা বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগ দেয়ার সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
ব্রিকস ব্যাংক বাংলাদেশকে সদস্য করেছে এবং আগামী আগস্ট মাসের সম্মেলনে তারা বাংলাদেশকে ব্রিকসের সদস্য করতে পারে। ব্রিকসের একাংশের রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মুদ্রা ডলারের আধিপত্য মোকাবেলায় নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। এসব প্রেক্ষাপটে ব্লকটিতে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধা কী হবে তা নিয়ে আজকের আলোচনা।
বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সুবিধা : ব্রিকসে রয়েছে রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তি এবং ভারত। ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও দুই মহাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী দু’টি দেশ। দেশের অনেক ব্যক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্তকে বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা বহুমুখীকরণের উদ্যোগ হিসেবে স্বাগত জানায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এটি কোনো বাণিজ্য জোট নয়, তাই যোগ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোটটি যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন ডলারের আধিপত্য হ্রাসের লক্ষ্যে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাই মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা পাওয়া যাবে। জানা যাচ্ছে, অক্টোবরে বিকল্প মুদ্রা চালুর বিষয়টি বিবেচনা করছে এনডিবি। ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে, চীন ও ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ দুই বাণিজ্য অংশীদার; আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশই এ দুই দেশ থেকে করা হয়। ইতোমধ্যে ২০২২ সালে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের রফতানি হয়েছে ৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং একই অর্থ বছরে আমদানি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের চ্যালেঞ্জ: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির ব্রিকসকে একটি ‘শিথিল ধরনের অর্থনৈতিক জোট’ বলে অভিহিত করেন, যেখানে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ভূ-রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হওয়া দোষণীয় নয়। তবে ব্রিকসে যোগ দেয়া বা না দেয়ার লাভ-ক্ষতির একটি বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে ডি-ডলারাইজেশন ও অভিন্ন মুদ্রা চালুর মতো পরিকল্পনা রয়েছে; সেখানে ভূ-রাজনীতিও জড়িত থাকায় যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হতে পারে।
বাংলাদেশ পশ্চিমা বলয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে আমদানি-রফতানি, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ, ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাজারই বাংলাদেশের রফতানি আয় বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ২০২১-২২ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট পণ্য রফতানির ২০ শতাংশেরই গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। মোট পণ্য রফতানির প্রায় ৫০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। সর্বমোট যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটভুক্ত দেশে বাংলাদেশের রফতানির ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) ১৯ শতাংশ করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রবাসী আয়ের শীর্ষ স্থান দখল করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, যা দেশের প্রবাসী আয়ের ২০ শতাংশ। ইইউ আমাদের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধার অধীনে যেকোনো পণ্য শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ দিয়েছে। সে কারণেই আমাদের প্রায় অর্ধেক তৈরী পোশাক রফতানি বর্তমানে ইইউতে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা না দিলেও দেশটিতে ২০ শতাংশ পোশাক রফতানি হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্রিকসভুক্ত চীন ও ভারত বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করে যা রফতানির চেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি যা হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ দিয়ে মেটাতে হয়। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের আন্তর্জাতিক প্রায় সব সংস্থা যেমন- জাতিসঙ্ঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এফএও ইত্যাদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ফলে বিভিন্ন সংস্থার ঋণ পাওয়া, অবরোধ থেকে রক্ষা পাওয়া যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব হবে না। অধিকন্তু, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিরাপত্তাকর্মী জাতিসঙ্ঘের মিশনে যায় যা থেকে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গেলে বাংলাদেশ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে ‘প্রতিবাদী অবস্থান’ এবং তির্যক বিভিন্ন মন্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলেছেন মাইকেল কুগেলম্যান। জার্মানির দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক জেসমিন লর্চও বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে অথচ একই সময়ে সরকার দলের নেতারা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করছেন। তাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেন।’
বাংলাদেশ এমন এক সময়ে এসে ব্রিকসে যোগদানের পরিকল্পনার কথা জানাল, যখন দেশটি কয়লা ও জ্বালানিসহ অনেক পণ্য আমদানির খরচ মেটাতে ডলারের চরম ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘যদি ঢাকা সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারে, তবে পশ্চিমের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেও ব্রিকসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের লাভ তুলে আনতে পারবে। তবে কুগেলম্যানের মতে, পশ্চিমকে অবজ্ঞা করার কৌশল হিসেবে ব্রিকসে যোগ দিলে ভুল করবে বাংলাদেশ।
ব্রিকস থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং বাস্তবতা: ডলার পতন আন্দোলনের ইতিহাসের ভিত্তিতে বলা যায়, ডলারের আধিপত্যে এত তাড়াতাড়ি ধস নামানো সহজ না-ও হতে পারে। পারস্পরিক অনেক মিল থাকার পরও, ইউরোজোনের ২০টি দেশের মুদ্রা ইউরো ২৩ বছরের প্রবল যুদ্ধের পর ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সির (জিআরসি) ২০ শতাংশ শেয়ার লাভ করতে পেরেছে। অথচ ব্রিকস হলো এমন কিছু দেশের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা যার দেশগুলোর পরস্পরের সাথে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। দেশগুলো যেন মুক্তবাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ, মিশ্র অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে গণতন্ত্রী ও স্বৈরাচারী কিছু দেশের একটি ককটেল। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ তাদের নিজেদের মধ্যে যতটা না ব্যবসায় করে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায় করে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের সাথে। চীন ও ভারতের বর্ডার নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী এবং বর্তমানে তা বহুগুণে বাড়ছে। রাশিয়া অর্থনৈতিক ও আর্থিকভাবে স্ব-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্রাজিল এক দশক পিছিয়ে পড়েছে; দক্ষিণ আফ্রিকা করোনা মহামারীর আগেও মন্দার খাদে আটকে গিয়েছিল। এ ছাড়া জিআরসি হিসেবে কাজ করার জন্য যথেষ্ট কার্যকর মুদ্রা তৈরি করার জন্য ব্রিকস দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় স্তরের আস্থার অভাব রয়েছে। এমনকি চীনের অর্থনীতি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মুক্ত, লিক্যুইড ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত পুঁজিবাজার নেই।
বাংলাদেশে আসন্ন ২০২৪ সালের নির্বাচনও সরকার আগের দু’টি নির্বাচনের মতো একইভাবে করতে চাচ্ছে। দেশের জনগণ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা জোটের দেশগুলো তা চাচ্ছে না। ফলে, গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন; মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে। র্যাব ও এর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও দু’টি গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং সর্বশেষ ভিসানীতি আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র তা প্রমাণ করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে এমনটি নয়; বরং বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা বাড়তে শুরু করায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার কারণে বিশ্বরাজনীতি এখন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই দুই দেশের বিপরীতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পক্ষে চায়।
অন্যদিকে, চীন-ভারত-রাশিয়া মানবতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে গিয়ে বাংলাদেশকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যা মূলত ভূ-রাজনৈতিক কারণেই। বাংলাদেশের এত বন্ধুপ্রতিম দেশ চীন-ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিষ্কারভাবেই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বেশ আটঘাট বেঁধেই সমর্থন দিয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশের পশ্চিমা দাতাদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর বিষয়ে ভূমিকা রাখতে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগে চীন মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে কোনো শর্ত আরোপ করছে না। এতে কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন।
অন্য দিকে, ভারত বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশীর মতো বন্ধুসুলভ আচরণ না করে সবসময় প্রভুসুলভ আচরণ করে। বাংলাদেশ থেকে ভারত এহেন কোনো সুবিধা নেই যা নেয়নি; দেয়নি তেমন কিছুই। বাংলাদেশের গত দু’টি নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ভারত কোনো রাখঢাক ছাড়াই সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে। এ বিষয়ে একসময় ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে একনিষ্ঠ সমর্থন ছিল মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারতনির্ভর নীতির কারণে। সেই অবস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এসেছে বলে মনে হয়। আবার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পরে দুই চরম প্রতিদ্ব›দ্বী দেশ ভারত ও চীনের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরুদ্ধে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ এই পরিবর্তনগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
পরিশেষে বলতে হয়, দেশের রাজনীতিতে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ক্ষমতা ধরে রাখা এবং একই সাথে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। সরকার যদি তেমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের চাপ উপেক্ষা করার পথ ধরবে। বাংলাদেশ তখন নিশ্চিতভাবেই চীনকে পাশে পাবে, আর ভারত তো যেকোনো পরিস্থিতিতেই এই সরকারের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরী সম্পর্ক করে ভারত-চীন ব্লকে যাওয়া এখনই বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমারা যদি স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে থাকে তো চীন-ভারতও তাদের স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ধ্বংসে সমর্থন দিচ্ছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন আগের দু’টির মতো কোনো কৌশলে একতরফা করার চেষ্টা করলে দেশের জনগণ তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেটি আমরা উদযাপন করতে পারি; এর থেকে সুবিধা নিতে পারি। কিন্তু ভূ-রাজনীতি যদি দেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, জনগণ যদি সেখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে তা সত্যিই দেশের জন্য বিপদের কথা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট