মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মকাণ্ডের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছে বিএনপি। ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে’ কিংবা ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাতে’ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত আছে কি না, তা দলটি এখন প্রতিদিনই পর্যবেক্ষণ করছে। মাঠপর্যায়ে পুলিশের ভূমিকাকে এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি নজড়দাড়িতে রাখা হয়েছে। প্রতিটি হামলা-মামলার সাথে যুক্ত কর্মকর্তাদের সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলেছেন, মার্কিন ভিসানীতির পর প্রশাসন কিংবা সরকারের আচরণে লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন এখনো দেখা যায়নি।
চলতি জুলাই মাসের শেষদিকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। এই আন্দোলনকে সামনে রেখে সরকারের পাশাপাশি প্রশাসনের দিকে দলটির রয়েছে তীক্ষè নজড় । বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও চাপ কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে সফল করতে চায় বিএনপি। তাই মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পরে বিচারালয়, পুলিশ, সিভিল প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা অর্থাৎ নেতাদের মামলার ক্ষেত্রে রায় কেমন হচ্ছে, জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের অবস্থান কী, পুলিশ ও মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন- সেগুলো খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপির দীর্ঘদিনের অভিযোগ, সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনকে অপব্যবহার করে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, পুলিশ প্রশাসনই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। সে কারণে আন্দোলন সফলে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন ও জনগণের প্রতিপক্ষ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে দলটি। মার্কিন ভিসানীতির পরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে আরো জোরালোভাবে এই আহ্বান জানানো হচ্ছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, মার্কিন ভিসানীতি ছাড়াও আগামীতে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর বিদেশী চাপ অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া সরকারের পাশাপাশি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডও পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক মহল। তাই সবকিছু মিলিয়ে আগামীতে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা বিএনপির।
মার্কিন ভিসানীতির পর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন ও নির্যাতন এবং মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দায়েরের সাথে জড়িতদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত মে মাসে প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে বিএনপির কেন্দ্র থেকে জেলা ও মহানগরে চিঠি পাঠানো হয়। এছাড়া ২৩ মে বিএনপির পক্ষ থেকে ১৪ সদস্যের একটি ‘তথ্য সংগ্রহ কমিটি’ও গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গায়েবি ও মিথ্যা মামলা, গুম-খুন, সহিংস আক্রমণ, ক্রসফায়ার দেয়া, অগ্নিসংযোগসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন, যা অব্যাহত রয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের দেয়া তথ্যে তালিকায় এখন পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি পুলিশ কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে।
দলটির দাবি, গত ১৪ বছরে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন, নির্যাতন ও গায়েবি মামলা দায়েরের সাথে এরা জড়িত। তাদের মধ্যে পুলিশের তৎকালীন ডিসি, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, এএসপি, ওসি, এসআই রয়েছেন, যারা বর্তমানে ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাপ্ত এসব তথ্য এখন যাচাই-বাছাই চলছে। চূড়ান্ত হওয়া তালিকা দলীয় আর্কাইভে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি প্রয়োজনে মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস ও হাইকমিশনে পাঠানো হবে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে যাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে অন্তত অর্ধশত পুলিশ কর্মকর্তার একটি তালিকা ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসসহ বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে, যা অব্যাহত থাকবে। ‘তথ্য সংগ্রহ কমিটি’র একজন সদস্য গতকাল বলেন, দলের তৃণমূলের তথ্যে ইতোমধ্যে অতীতে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দায়ের, গুম-খুন এবং নির্যাতনের সাথে জড়িত পুলিশের অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে কমিটির এখন মূল ফোকাস হচ্ছে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পরের ঘটনাবলী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এ লক্ষ্যে বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কী, তা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে প্রত্যেকটি ঘটনার অডিও-ভিডিওসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা দিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করা হচ্ছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
বিএনপির তথ্য সেলের আরেক নেতা বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু কিছু জায়গায় এক ধরনের নীরবতা লক্ষ করা গেছে। তবে সেটি তাদের সাময়িক কৌশলও হতে পারে। সময়মতো তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন। তাছাড়া দেশের অনেক জায়গায় এখনো নেতাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত স্থির কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি তারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৪ মে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমাদের কাছে এখনো প্রতীয়মান হয়নি যে, প্রশাসন কিংবা সরকারি দলের আচরণে কোনো পরিবর্তন এসেছে।
রিজভী বলেন, আমরা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছি। যখনই কোথাও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে, তার সকল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এগুলো সময়মতো প্রকাশ করা হবে।
বিএনপির দাবি, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করা হয়েছে। আর এ কাজে পুলিশ ও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা সহায়তা করেছেন। দলটির পক্ষ থেকে এমন কর্মকর্তাদের একটি পৃথক তালিকাও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- তাদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। প্রশাসনের সেসব কর্মকর্তা এখন কে কোথায় রয়েছেন, দলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই খবর নেয়া হচ্ছে।
তাদের তালিকা করা হচ্ছে। বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এই তালিকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব তালিকাও সংরক্ষণ করার পাশাপাশি প্রয়োজনে বিভিন্ন দূতাবাসেও পাঠানো হতে পারে। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, চলতি জুলাই মাসের শেষদিকে একদফা আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বিএনপি ও এর মিত্ররা। তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে আবারো জনসম্পৃক্ত ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আসবে। তবে তা আরো জোরালোভাবে, আরো শোডাউনের মাধ্যমে পালিত হবে। আর আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি হবে ঢাকামুখী ও ঢাকাকেন্দ্রিক। তবে বাধ্য না হলে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচিতে যাবে না দলটি। এক্ষেত্রে ঢাকামুখী রোডমার্চ, চলো চলো ঢাকা চলো, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, গণভবন ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও, অবস্থান, বড় সমাবেশের মতো কর্মসূচি আসতে পারে।