বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী লক্ষাধিক রোহিঙ্গা চর্মরোগ চুলকানিতে আক্রান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংস্থা মেডেসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স বা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) তাদের জন্য জরুরি সেবার দাবি জানিয়েছে।
এমএসএফ বলছে, এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যাপকহারে দ্রুত সেবা দিতে হবে। ক্যাম্পের মধ্যে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির উন্নতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বর্তমানে জনাকীর্ণ শিবিরের আনুমানিক ৪০ শতাংশ লোকের চুলকানি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে কিছু শিবিরে প্রাদুর্ভাব ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
চুলকানির চিকিৎসা করা সহজ। কিন্তু চিকিৎসা না করা হলে গুরুতর শারীরিক এবং মানসিক প্রভাব হতে পারে। স্বাভাবিক চিকিৎসার মধ্যে রোগীর ত্বক, কাপড় এবং বাড়ির পরিবেশে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যাতে সংক্রমণের কারণ হওয়া পরজীবীটি নির্মূল করা হয়।
তবে এই ক্ষেত্রে ওষুধগুলোই যথেষ্ট হবে না এবং প্রাদুর্ভাবের উত্সটি মোকাবেলা করা দরকার বলে সতর্ক করেছে এমএসএফ।
বাংলাদেশে এমএসএফ-এর মিশনের প্রধান কার্স্টেন নোকো বলেন, ‘বর্তমান প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করার জন্য ক্যাম্পের মধ্যে ওষুধের ব্যাপক বণ্টন নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র ওষুধই পুনঃসংক্রমণ রোধ করবে না যদি তারা প্রাদুর্ভাবের কারণ হওয়া অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ব্যবস্থা না করে।’
ক্যাম্পে এমএসএফ দলগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চর্মরোগের ক্রমবর্ধমান সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা করেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে তারা চর্মরোগীদের অস্বাভাবিকভাবে বেশি সংখ্যক দেখতে শুরু করে। তারপর থেকে সংখ্যাটি দ্রুত বেড়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি এবং মে মাসের মধ্যে ক্যাম্পে এমএসএফ দলগুলো প্রায় ৭০ হাজার রোগীকে চর্মরোগ চুলকানির জন্য চিকিৎসা দিয়েছে। যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
এমএসএফ বাংলাদেশের ডেপুটি মেডিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ডা. পঙ্কজ পাল বলেন, ‘কিছু দিনে আমরা ৭০০ রোগীর শীর্ষে পৌঁছেছি। পরিস্থিতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত একই ছিল এবং এই বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া জানাতে একটি বিশাল কাজের চাপ থাকার সময় আমরা এটি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। আমাদের দল রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান দেখছিল এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা রোগীদের তাদের নিজ নিজ ক্যাম্পের কাছাকাছি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পুনর্নির্দেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মুহূর্তে, আমরা চর্মরোগ নিয়ে আসা প্রত্যেকের চিকিৎসা করতে পারি না- আমাদের সেই ক্ষমতা নেই।’
ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্য আজমত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের চার বছর বয়সী ছেলের গত ডিসেম্বর থেকে খোস-পাঁচড়া হয়েছে। ‘তার হাতে এবং তারপরে সারা শরীরে ফুসকুড়ি হতে শুরু করে। আমরা ডাক্তার এবং ফার্মেসিতে টাকা খরচ করেছি এবং শেষ পর্যন্ত সে ভালো হয়ে গেছে, কিন্তু খুব দ্রুত সে চর্মরোগে পুনরায় সংক্রমিত হয়েছিল। সে খুব বেশি ঘুমায় না, তার সারা শরীর চুলকায়, বিশেষ করে রাতে। ব্যথায় সে অনেক কান্নাকাটি করে। আমার অন্য দুই ছেলেরও চর্মরোগ আছে এবং আমার স্ত্রী এবং আমারও লক্ষণ রয়েছে। এটা আমার পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বাংলাদেশে মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স গত বছর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতির ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে এবং এতে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েচে। তারা বলছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি সঠিক স্যানিটেশনের অভাব এবং পানির অপর্যাপ্ত প্রাপ্যতা রয়েছে।
যদিও আমরা গত দুই বছরে (পানির লাইন স্থাপন, ক্লোরিনেশন) যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও স্যানিটেশন পরিকাঠামোর উন্নতি দেখতে পাচ্ছি। তবে রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি রয়েছে।
আগের তুলনায় কম চালু ল্যাট্রিন আছে। কিছু কিছু এলাকায় মানুষ প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টা পানি পান।
এটি খারাপভাবে কাজ করা পানির ব্যবস্থার কারণে কিন্তু এটি ভুল ধারণার অধীনে পানির নির্দিষ্টকরণের সঙ্গে যুক্ত যে শরণার্থী জনসংখ্যা দ্বারা ভূগর্ভস্থ পানির সংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। যা এই পানির উৎসগুলোর বিশেষ পর্যবেক্ষণ এবং মডেলিং দ্বারা খণ্ডন করা হয়েছে।
গত মাসে শরণার্থীদের সাবান বণ্টনে প্রতি মাসে দুটি বার এর পরিবর্তে মাত্র একটি বার করা হয়েছে।
জামতলী ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছর বয়সী শরণার্থী তাহের বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ‘আমরা স্বাস্থ্যবিধির মান বজায় রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু এটা কঠিন। আমরা বিছানা ভাগাভাগি করি, আমরা কাপড় ভাগাভাগি করি, আমরা সবকিছু ভাগ করি। এখন আমরা খোসপাঁচড়াও বা চুলকানিও ভাগ করে নিচ্ছি।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য নির্দিষ্ট হারে কমানো সহ তহবিল হ্রাসের প্রেক্ষাপটে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চর্মরোগের এই প্রাদুর্ভাব ঘটছে। তহবিল হ্রাসের আগেও, শিবিরের মধ্যে সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর দেওয়া পরিষেবার স্তর শরণার্থীদের চাহিদা পূরণ করেনি।
এমএসএফ-এর জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য সুবিধার সরবরাহের অভাব। যেখানে সম্পূর্ণ কর্মী এবং পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
নোকো আরও বলেন, ‘চর্মরোগের ৪০ শতাংশের ইতিবাচক হার হলো ‘কয়লা খনিতে ক্যানারি’ মুহূর্ত, যা আমাদের বলে যে ক্যাম্পে অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন প্রতিক্রিয়া কাজ করছে না। এটি রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের সুস্থতার জন্য আরও হুমকি ও ঝুঁকি তৈরি করছে।’ সূত্র : ইউএনবি