বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন

রূপনগরের ৮ বস্তি ‘টাকার খনি’

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০
  • ২৪৪ বার

রাজধানীর রূপনগরের চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিটি তিন দশক ধরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মীর কাছে ছিল ‘টাকার খনি’। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা ঝিলের ২০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা এ বস্তির প্রায় ১৫ হাজার ঘরের ভাড়া, চোরাই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন সংযোগের মাধ্যমে প্রতি মাসেই তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গত ১৬ আগস্ট ভয়াবহ এক অগ্নিকা-ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বস্তিটি। এখানকার বাসিন্দা দন্ত চিকিৎসক ফরিদ সরদারের ঘরের সুইচবোর্ডে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে লাগা এ আগুন চোখের সামনে ভস্ম করে দেয় ঝিলপাড় বস্তির হাজার ঘর। ওই ঘটনায় গঠিত ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসেÑ বস্তিজুড়ে অবৈধভাবে টানা বিদ্যুৎ-গ্যাসের প্লাস্টিক লাইনের কারণে দ্রুত ছড়িয়েছে আগুন।

ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা তখন আমাদের সময়কে বলেছিলেন, বস্তিতে গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে এত বাণিজ্য হয় তা আমার জানা ছিল না। আপনারা তথ্য দেন, অন্য যে কটি বস্তি রয়েছে, সেগুলোয় অবৈধ কোনো সংযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে গ্যাস-বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমি নিজেই অভিযানে যাব। এখন থেকে কেউ আর অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করতে পারবে না। আমার নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ এ অপকর্মে যুক্ত হয়, তাদের আমি নিজেই আইনের কাছে সোপর্দ করব। কিন্তু গত বুধবার রূপনগরের ‘ট‘ ব্লক বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর সরেজমিনে ঝিলপাড় বস্তি ঘুরে জানা গেল, সাংসদ ইলিয়াস মোল্লার সেই আশ্বাস ছিল শুধু কথার কথা। কারণÑ গত ৭ মাসেও বস্তির এ অবৈধ আয়ের সঙ্গে জড়িত কেউই তো গ্রেপ্তার হয়ইনি; উল্টো সেই বস্তিতে নতুন করে ঘর তুলে ফের চোরাই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন সংযোগের জমজমাট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সম্প্রতি পুড়ে যাওয়া ‘ট’ ব্লক বস্তিতেও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন সরবরাহ করে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাড়া ও বিল বাবদ কোটি টাকারও বেশি আদায় করত বলে জানা গেছে।

শুধু পুড়ে যাওয়া এ দুই বস্তিই নয়Ñ রূপনগর থানা এলাকায়ই রয়েছে আরও ৬টি বস্তি। ঢাকা উত্তরের ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড ঘিরে গড়ে ওঠা অন্য বস্তিগুলো হলো কমিশনারের বস্তি, দুয়ারিপাড়া তালতলা বস্তি, শিয়ালবাড়ি বস্তি, লেকপাড় বস্তি, বেগুন টিলা ও ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বালু মাঠ বস্তি। এসব বস্তির প্রায় ৫০ হাজার ঘরে চোরাই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন সরবরাহের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী প্রতি মাসে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ২০০ থেকে ৫০০ ঘরের দায়িত্ব দেওয়া হয় একেক জনকে। পাঁচ-ছয় হাতের প্রতিটি ঘর থেকে গড়ে আড়াই হাজার টাকা মাসোহারা তোলা হয়। ঘরভাড়া এবং বিভিন্ন সেবার লাইন থেকে প্রতি মাসের সুনির্দিষ্ট আয় বলা না গেলেও স্থানীয় সূত্র ও বস্তির দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জানা গেছেÑ এর পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা। এসব বস্তির টাকায় অনেকেই হয়েছেন অট্টালিকার মালিক।

বস্তির নিয়ন্ত্রকরা এতটাই ভয়ঙ্কর যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ওডসকো) ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের চোরাই সংযোগ দিচ্ছে নিজেরাই। বছরের পর বছর সবকিছুই ঘটছে চোখের সামনে। কিন্তু নীরব ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কালে-ভদ্রে লোক দেখানো কিছু অভিযান চালানো হলেও আদতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নেরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যাদের দায়িত্ব এ অনিয়ম রুখে দেওয়া- স্থানীয় সেই সাংসদ ও কাউন্সিলর থেকে শুরু করে ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ সংযোগের বিষয়ে তারা অবগত নন। চাঁদাবাজির বিষয়টিও তাদের নজরে আসেনি। বস্তিতে অবৈধ সংযোগ প্রদানকারীদের তথ্য খতিয়ে দেখা ছাড়াও অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানান তারা।

নির্ভরযোগ্য সূত্র ও বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লুটেরা এ বিশাল চক্রের সিন্ডিকেটে জড়িত রয়েছে রূপনগর থানাপুলিশ, ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা। অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে আদায় করা অর্থের ২৫ ভাগ প্রতি মাসে পান তিতাস গ্যাস কোম্পানির ওই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিদ্যুৎ সংযোগের ২০ ভাগ অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয় রূপনগর থানা ও ডেসকোর লোকজনের হাতে। ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তারাও মাসের ৫ তারিখের মধ্যেই পেয়ে যান ১০ ভাগ টাকা। স্থানীয় মাস্তান-সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামেও বরাদ্দ রয়েছে। সবার যোগসাজশে গড়া শক্ত সিন্ডিকেটের কারণে তিনটি সেবা খাতের মধ্যে গ্যাস থেকে এক কানাকড়িও যায় না সরকারের ঘরে। তবে বিদ্যুৎ ও পানি থেকে যৎসামান্য অর্থ জমা হয় সরকারি কোষাগারে।

জানা গেছে, ট-ব্লক বস্তির প্রায় ৫ হাজার ঘর থেকে ভিটি ভাড়া এবং অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহের মাধ্যমে প্রতি মাসে তোলা হতো এক কোটিরও বেশি টাকা। চোরাই সংযোগের মাধ্যমে দুই ঘরপ্রতি বরাদ্দ ছিল একটি ডাবল গ্যাসের চুলা। যাদের ভাড়া ৩ হাজার টাকা, তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি চুলা। প্রতি ডাবল চুলা থেকে মাসিক ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত নেওয়া হতো ১২০০ টাকা এবং সিঙ্গেল চুলায় আদায় করা হতো ১ হাজার টাকা। একটি লাইট-ফ্যান-টিভির জন্য ঘরপ্রতি গুনতে হতো ৩০০ টাকা। ফ্রিজ চালালে আলাদা দিতে হতো ২০০ টাকা। রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ দোকানিকে প্রতি বৈদ্যুতিক লাইটের জন্য দৈনিক দেওয়া লাগত ১০০ টাকা। পানির সংযোগ থেকে উঠানো হতো প্রায় ৩ লাখ টাকা।

বস্তিবাসী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ভাষ্যÑ এসব বস্তির নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑ হাজী রজ্জব হোসেন, নূর আলম খোকন, দুলাল হোসেন ওরফে কারেন্ট দুলাল, সোহেল রানা, রাসেল, রনি, ডিশবাবু, কবির আহমেদ, খোকন, জাহাঙ্গীর হোসেন, নুরুল ইসলাম, আনসার মিয়া, মোহাম্মদ দিলু, মোহাম্মদ হানিফ, তুষার, মিঠু, হেলাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, মতিউর রহমান ওরফে খোকন, আক্তার হোসেন, খলিলুর রহমান ও তৈয়ব আলী, ফকির কবির, জামাল, ডিশ রকি চৌধুরী, মিজান, বাইট্টা খলিল, ভিডিও বাবু, মনির মোল্লা, ফারুক হারুন, মিল্ক ভিটা সোহেল, নূরে আলম খোকন, শেখ মো. নাছির, জহুর মাতবর, এনালান খান, সাত্তার মাতবর, হারুন, শরীফ মাতবর, মজিবুর রহমান ওরফে ভাঙারি মুজিবর, মারুফ মাতবর, ওমর আলী মাতবর ও আনিস ‘আর্মি’, এসএ খোকন, আবদুুর রহিম সর্দার, রাসেল মোড়ল, এনামুল ওরফে মামা ভাগনে দোলন শুভ, ছাত্রলীগ কর্মী আলীম ও ইব্রাহিমসহ অর্ধশত ব্যক্তি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com