বাংলাদেশের পাহাড়ি জেলাগুলো বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার পর সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা তারা আগে আর দেখেননি।
বান্দরবানের লামার বাসিন্দা আব্দুল্লাহর বাড়ি পানিতে ডুবে যাওয়ায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পুরো পরিবার উঁচু একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। তিনদিন ধরে তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, ফলে চার্জ করতে না পেরে মোবাইলও চলছে না। তাদের কাছে খাবারও খুব কম রয়েছে।
বুধবার (৯ আগস্ট) সোলার ব্যবহার করে তিনি ১০ মিনিটের জন্য মোবাইল চালু করতে পেরেছিলেন। সেই সময় বিবিসি বাংলার সাথে কথা হয় তার।
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। কোনোদিন এভাবে এখানে পানি উঠবে ভাবি নাই, তাই কারো কোনোরকম প্রস্তুতিও ছিল না। অনেকটা হঠাৎ করে ঘরবাড়ি ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছে। কারো সাথে যোগাযোগও করতে পারছি না।’
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে সাঙ্গু আর মাতামুহুরি নদী উপচে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি আর কক্সবাজারের বহু অঞ্চল তলিয়ে গেছে। পাহাড়ি এলাকাগুলোয় এর আগে এমন বন্যা আর দেখা যায়নি।
বান্দরবান শহর এলাকাও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আর সাব-স্টেশনগুলোয় পানি ঢুকে পড়ায় গত তিনদিন ধরে শহর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। চার্জ দিতে না পারায় সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না। সারা দেশের সাথে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদী যেসব এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে, তার আশপাশের সব এলাকাই বন্যাক্রান্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
কক্সবাজারের চকোরিয়ার বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘মা স্ট্রোকের রোগী হওয়ায় কোথাও যেতে পারি নাই। খাটের নিচে পাঁচটা ইট দিয়ে উঁচু করে ঘরের মধ্যেই আছি, বাইরে বের হওয়ারও কোনো সুযোগ নাই। আশপাশের বহু মানুষ যেভাবে পারছে, অন্যদিকে চলে গেছে।’
তিনি আরো জানান, সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে তারা এমন বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারপর আর চকোরিয়ায় এমন বন্যা হয়নি।
তবে বাংলাদেশের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, এসব এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে। আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় হঠাৎ এই বন্যার কারণ কী?
পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় হঠাৎ করে এমন বন্যার পেছনে কয়েকটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘এবারের বন্যার পেছনে মূল কারণ হলো গত কয়েকদিনের বৃষ্টি। সাধারণত পুরো অগাস্ট মাসে বান্দরবানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় গড়ে সাড়ে চার শ’ মিলিমিটার। কিন্তু শুক্রবার (৪ আগস্ট) থেকে মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) এই পাঁচদিনে বৃষ্টিপাত হয়েছে আট শ’ মিলিমিটারের বেশি। অর্থাৎ এক মাসের চেয়ে দ্বিগুণ বৃষ্টি হয়ে গেছে পাঁচদিনে।’
তিনি বলেন, ‘অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় মাতামুহুরি এবং সাঙ্গু নদীর স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা পার হয়ে গেছে, যে কারণে এই বন্যা দেখা দিয়েছে। কারণ পাহাড়ের বিভিন্ন ঢল এবং বৃষ্টির পানি নদীতে একসাথে নামতে গিয়ে উপচে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। যেসব এলাকা দিয়ে এই দুটি নদী প্রবাহিত হয়েছে তার আশপাশের এলাকা মূলত বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকট অতীতে এমন বন্যার উদাহরণ আর দেখা যায়নি। বান্দরবানের লামা পয়েন্টে নদীর পানি বাড়ার যে রেকর্ড ছিল, সেটা এর মধ্যেই পার হয়ে গেছে। গত ৫০ বছরে এই পয়েন্টে গড় সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ৫০ মিটার, এবার সেটা হয়েছে ৫০ দশমিক চার শূন্য মিটার।
বন্যার পেছনে আরো কয়েকটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় বাসিন্দারা।
রায়হান বলছেন, ‘আমরা দেখেছি, প্রতি বছরই নানা কারণে বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি বহন করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অতীতে এসব নদী যে পরিমাণ পানি বহন করতে পারতো, সেটা হারিয়ে ফেলছে। ফলে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হলে বা নদীতে পানি বেড়ে গেলে সহজেই আশপাশের এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যা ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে পাহাড়ি এলাকাগুলোয় নদীর কাছাকাছি নিচু এলাকায় আগে জনবসতি ছিল না। কিন্তু এখন সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। ফলে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় এসব এলাকা বন্যাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
তবে বন্যার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি অপরিকল্পিত উন্নয়নসহ আরো কয়েকটি কারণ দেখছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ বলছেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যে রেললাইনটি তৈরি করা হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি চলাচলের জায়গা বা কালভার্ট রাখা হয়নি। ফলে আগে পাহাড়ি বৃষ্টিপাতের পানি নেমে যেতে পারতো কিন্তু এখন রেললাইনে এসে আটকে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে এসব পানি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
চকোরিয়ার বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান বলছেন, ‘আমাদের এলাকায় অনেক ছোট ছোট খাল বা নালা ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেগুলোকে বাধ দিয়ে দিয়ে চিংড়ির ঘের বানিয়েছেন। ফলে আগে পাহাড় থেকে পানি নামলেও পানি সরে যেতে পারতো কিন্তু এখন বাধের কারণে সেই পানি আর সরতে পারছে না। তার সাথে রেললাইনের কারণেও পানি সরতে পারছে না। এসব কারণে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতেই আমাদের এলাকা তলিয়ে গেছে।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এই জেলার ৬০টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে বান্দরবানে বন্যার শিকার হয়েছে ২১ হাজার মানুষ। সেখানে এ পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু হয়েছে।
পরিস্থিতির উন্নতি কবে?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগড়া উপজেলা, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা, বান্দরবানের রামু উপজেলা এবং রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির কিছু জায়গা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তবে বুধবার থেকে কিছু কিছু এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে।
বান্দরবানের পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না কর্মকর্তারা। তাদের মতে, পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপরে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা তো সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এটা তো প্রাকৃতিক বিষয়। বৃষ্টি না থামলে আর নদীর পানি না কমলে তো আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না কবে পুরো স্বাভাবিক হবে।’
জেলার বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকায় তারা আপাতত বিদ্যুৎ চালু করছেন না। তবে নদীর পানি নেমে গেলেই আবার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সরদার উদয় রায়হান বলেছেন, ‘আগামী দু’দিন ওই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, দু’তিনদিনের মধ্যেই বন্যার পানি অনেক নেমে যাবে।’
বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বন্যার পানি নেমে গেলেই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হবে। আপাতত দুর্গত মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ করা হচ্ছে। সেই সাথে এসব নদী যাতে খনন করা হয় সেই সুপারিশও করা হবে।
সূত্র : বিবিসি