গরিবের আমিষ খ্যাত ডিমের বাজার অস্থিতিশীল। দাম বাড়তে বাড়তে এক ডজন ডিম এখন রেকর্ড ১৭০-১৭৫ টাকায় ঠেকেছে। অর্থাৎ প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকার উপরে। গত দুই সপ্তাহ হলো ডিমের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে হা হুতাশ দেখা দিয়েছে। ডিমের মূল্য বৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষের পরিবারে পুষ্টিতে টান পড়েছে। নিজস্ব উৎপাদন থেকেই গত কয়েক বছর ধরে ডিমের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। ডিমের বাজার নিয়ে সিন্ডিকেটের প্রশ্ন উঠলেও সেই সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। ফলে মাঝে মধ্যেই কথিত সিন্ডিকেটের থাবায় সাধারণ মানুষের প্রোটিনে টান পড়ছে। ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যাচ্ছে ডিম।
এদিকে, ডিমের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য করণীয় নির্ধারণে গতকাল রোববার সচিবালয়ে বৈঠক করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদা রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা ছাড়াও পোলট্রি খাতের করপোরেট কোম্পানিগুলো এবং বাচ্চা উৎপাদনকারী কোম্পানির মালিক ও সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। কিন্তু এই বৈঠকে ডাক পাননি ডিম উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি বা তাদের সংগঠনের নেতারা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন মহাসচিব খন্দকার মোহসিন নয়া দিগন্তকে বলেন, ডিমের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার এই মিটিংয়ে বাচ্চা উৎপাদনকারীদের (ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন) ডাকা হয়। কিন্তু যারা ডিম উৎপাদন করেন তাদের ডাকা হয়নি। সরকার ২০১০ সালে মুরগির বাচ্চা ও ডিমের মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি কমিটি করে দিয়েছে। সেই কমিটিকে কখনো ডাকা হয় না। বাচ্চা উৎপাদনকারীদের নিয়ে সরকার মিটিং করেছে, ডিমের দাম সহনীয় রাখার মিটিংয়ে তাদের কাজ কি? অথচ চাহিদার ৭৮ শতাংশ ডিম উৎপাদন করেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি। বাকি ২২ শতাংশ উৎপাদন করে করপোরেট কোম্পানিগুলো।
খন্দকার মোহসিন জানান, ১৯৯৩ সালে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়ে এই সেক্টরে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন। ক্ষুদ্র খামারিদের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ এগ প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনসহ আরো সংগঠন আছে খামারিদের। কিন্তু তাদের না ডেকে কেন শুধু করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ডাকা হয়?
তিনি বলেন, দেশে প্রতিদিন ৪ কোটি ৭০ লাখ ডিমের চাহিদা। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৯০ লাখ থেকে ৪ কোটি ১০ লাখ পিস পর্যন্ত। গত দুই সপ্তাহ টানা গরমের আগে উৎপাদন ছিল প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ। অতি গরম, লোডশেডিংয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ডিম উৎপাদন ১০ শতাংশ কমেছে। এছাড়া তিনি আরো একটি যুক্তি দেন ডিমের দাম বাড়ার জন্য। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে খাল, বিল নদীতে মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। মাছের সরবরাহ কম থাকায় দাম অনেক বেশি। তাই সবাই ডিমে ঝুঁকেছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি রক্ষা জাতীয় পরিষদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এ কে এম ফজলুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধিত্ব করি। সারা দেশে জেলা উপজেলায় কমিটি রয়েছে আমাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি মিটিংয়ে আমাদেরকে ডাকা হয় না। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমরা মিটিংয়ে গেলে যেসব কথা বলবো তা হয়তো তারা চায় না।
তিনি বলেন, আমরা মুরগির খাবারের মূল্য কমানোর জন্য বলছি। বর্তমানে আন্তর্জাতিকবাজারসহ সব পর্যায়ে ভুট্টা ও সয়াবিনের মূল্য কমেছে। কিন্তু সেভাবে মুরগির খাবারের মূল্য কমানো হয়নি। ব্রিডার অ্যাসোসিয়েশন বা করপোরেট কোম্পানিগুলো একইসাথে ফিড মিলেরও মালিক। তারা একই সাথে বাচ্চা উৎপাদন করে, ডিম উৎপাদনও করে। পৃথিবীর কোনো দেশে এ রকম নাই।
এদিকে, গতকাল সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠকের পর ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)-এর সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান ডিমের দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকেই এই কথাটা বলে আসছি। ডিমের দাম কোরবানির ঈদের পরে অনেক বাড়তে থাকবে। কেন বাড়তে থাকবে? কারণ গত বছর থেকে লক্ষ্য করছি যে আমাদের ডিমের দাম বাড়লো; কিন্তু বাচ্চার দাম বাড়ে না। তিনি বলেন, দেখা যায় বাচ্চার উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ টাকা। কিন্তু বছরের পর বছর লেয়ার বাচ্চা ৩০ টাকা, ২৫ টাকা, ১৫ টাকা- এভাবে বিক্রি হচ্ছিল।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি ডিম দরকার। উৎপাদন হচ্ছে চার কোটি বা ৪ কোটি ২০ লাখ। কখনো-কখনো আরো কম হচ্ছে। এটি একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। এখানে যদি উৎপাদন ১০ লাখ কমে তাহলে কিন্তু ক্রাইসিস (সঙ্কট) হয়ে যায়। আর যদি ১০ লাখ বেশি হয় তাহলেও কিন্তু ওভার প্রোডাকশন হয়ে যায়।
গত কিছুদিন ধরে দেশের বাজারে ডিমের দাম ঊর্ধ্বমুখী। একটি ডিম ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সার্ভে অনুযায়ী, একটি ডিম উৎপাদনে সাড়ে ১০ টাকার ওপর খরচ পড়ে। তারপর অন্যান্য ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে কিছু লাভের বিষয় থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে, একটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। এই ১২ টাকা নির্ধারিত হলে যারা উৎপাদনকারী তাদের লাভ হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, দাম ১২ টাকার মধ্যে রেখে তারা ডিম বিপণনের ব্যবস্থা করবেন।
এর আগে রোববার সকালে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই ডিম আমদানি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমপোর্ট পারমিশন লাগবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া ডিম আমদানির সুযোগ নেই। আমি আশা করবো শিগগির এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রিন সিগন্যাল দিলেই ডিম আমদানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলেন, ডিম আমদানি করা না করার বিষয়টি আমরা অন্যভাবে বিবেচনা করবো। এই বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইন্ডিপেন্ডেন্টলি বিবেচনা করবে কি করবে না এটা তাদের বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশে যে উৎপাদন আছে, আমরা যদি বাজার ব্যবস্থা বিন্যাস করতে পারি তবে আমদানির কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমার মনে হয় না।
আজকের বাজারে ১৭০ টাকা ডিমের ডজন। এই দায় আসলে কার- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা উৎপাদনকারীদের বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেছি, বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এরপরও যদি কেউ জনদুর্ভোগ ডেকে নিয়ে আসেন, তা দেখভাল করার জন্য ভোক্তা অধিকার আইন আছে। ভোক্তাদের অধিকার দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। তারা প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবে।
মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দেবে কি না- এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, এটা দাম নির্ধারণ করার বিষয় না। এর আগে ২০১০ সালে ছোট বাচ্চা মুরগি ও অন্যান্য বিষয়ের দাম নির্ধারণের বিষয় উঠেছিল। সেক্ষেত্রে আদালত প্রশ্ন তুলেছিলেন, মন্ত্রণালয় এভাবে দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না।