আর্জেন্টিনার বর্তমান মুদ্রা ব্যবস্থা বিলুপ্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান মুদ্রা পেসোর জায়গা দখল করে নিতে পারে মার্কিন ডলার।
দেশটিতে চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন হ্যাভিয়ের মিলেই। দেশটির আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এখন পর্যন্ত প্রচারণার দিক থেকে বেশ এগিয়ে আছেন হ্যাভিয়ের মিলেই। তিনি যদি আর্জেন্টিনার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তাহলে পেসোর পরিবর্তে ডলারে দেশটির আর্থিক লেনদেন হবে।
আর্জেন্টিনার চলমান অর্থনৈতিক ভরাডুবি পরিবর্তনের লক্ষ্যে ডানপন্থীদের নির্বাচনি ইশতেহারে একথা বলা হয়েছে।
প্রচারণায় হ্যাভিয়ের মিলেই এগিয়ে থাকলেও দেশটির ৬০ শতাংশ মানুষ পেসোর পরিবর্তে মার্কিন ডলার চালুর বিপক্ষে। তারা মনে করে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক বেশি ক্ষমতা পাবে।
তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে পছন্দ হোক কিংবা না হোক- আর্জেন্টিনার অর্থনীতিতে ডলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকে মনে করে, মার্কিন ডলার তাদের জীবনে অবশ্যম্ভাবী একটি বিষয়।
ডলারে রূপান্তরের হিড়িক
আর্জেন্টিনার মানুষ অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতে অভ্যস্ত। কিছু অর্থ জমলেই তারা দ্রুত সেগুলো দিয়ে ডলার কিনে রাখে। কারণ তারা তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর খুব একটা ভরসা রাখতে পারেন না।
এর জন্য ব্যাংকের পরিবর্তে নিজেদের বিছানার ম্যাট্রেসের নিচে অর্থ জমা রাখে।
আর্জেন্টিনায় অর্থ জমিয়ে রাখার অনেক কাহিনী আছে। যেমন- বাগানে পুতে রাখা, দেয়ালের মধ্যে রাখা কিংবা কোনো যন্ত্রাশেংর ভেতর লুকিয়ে রাখা। মাঝেমধ্যে এসব অর্থ নষ্টও হয়ে যায়।
এসব লক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যায়, দেশটির অর্থনীতির কাঠামোগত কতটা প্রবল। যেকোনো জটিল রোগ যেমন একদিনে হয় না, তেমনি আর্জেন্টিনার এ সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি।
মার্কিন ডলারের প্রতি আর্জেন্টিনার মানুষের অনাস্থার থাকার খুঁজে বের করার জন্য ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকের দিকে তাকাতে হবে। তখন দেশটির অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহরূপ ধারণ করেছিল। এর ফলে শুধু ৮০-এর দশকেই আর্জেন্টিনার মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমেছিল।
তখন দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি এতটাই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল যে মানুষের মজুরির মান ও সঞ্চয় কমে হাস্যকর অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল। ফলে নিজেদের মুদ্রার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে মানুষ।
তাদের থাকা পেসোর মূল্য এত দ্রুত কমে যাচ্ছিল যে মানুষ হাতে অর্থ রাখতে চাইত না। এর জন্য তারা দুটি উপায় অবলম্বন করে অর্থ ধরে রাখত। এর মধ্যে একটি হলো প্রচুর পরিমাণে পণ্য কিনে রাখা ও অপরটি, ডলার ক্রয় করে রাখা। এই দুই পন্থা ছাড়া অর্থ জমানোর অন্য কোনো উপায় দেশটির জনসাধারণের নিকট ছিল না।
আগের মতো বর্তমান সময়েও দেশটি ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে। প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে জীবনযাত্রার মান। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি দাড়িয়েছে ১১৫ শতাংশ। ফলস্বরূপ, দেশটিতে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল ২৫ শতাংশ।
এ ধরনের পরিস্থিতি আজীবনের জন্য চলতে থাকুক তা পৃথিবীর কোনো আত্মমর্যাদাশীল সরকার চাইবে না। নিজ দেশের মুদ্রা পেসোর প্রতি আস্থা পুনরূদ্ধারের জন্য আর্জেন্টিনার সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়ে নিয়েছে। পেসোর যেন দরপতন ঠেকানো যায় তার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয় হয়েছে। পেসোর মান ধরে রাখতে ডলারের সরবরাহও বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।
নানা পদক্ষেপ
পেসোর প্রতি আস্থা পুনরূদ্ধারের লক্ষ্যে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী পদক্ষেপ নেয় হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ওই পরিকল্পনার মাধ্যমে পেসোকে ডলারের সমমূল্য হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক পেসো সমান এক ডলার- এভাবে রূপান্তর করার চেষ্টা হয়েছিল।
আগের সরকাররা ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করেছিল। এখন আদেশ জারি করা হয়েছে, প্রতি ডলারের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে এক পেসো রাখা হবে।
ধারণাটি এমন ছিল, মানুষ যে কোনো সময় পেসোর সাথে ডলারের পরিবর্তন করতে পারবে। কিন্তু মানুষজন এক পর্যায়ে এসে দেখল যে তাদের এটা করার প্রয়োজন নেই।
কিছু সময়ের জন্য তাদের এই ধারণা কাজও করেছে। তবে এই নীতির ফলে পরবর্তিতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ফলস্বরূপ, ২০০১-০২ অর্থবছরে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়ে।
একটি মুদ্রা ব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে আর্জেন্টিনা তাদের অর্থনীতিক নীতির ঠিকাদারি মূলত ওয়াশিংটনের কাছে দিয়ে দিল।
এর ফলে দুটি বিষয় সৃষ্টি হয়েছিল। একটি হচ্ছে, তাদের সরকারি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল এবং অপরটি হচ্ছে, মার্কিন অর্থনীতির উত্থান-পতন আর্জেন্টিনাকেও প্রভাবিত করতে লাগল।
বিনিময়ের নানা রেট
এই সঙ্কটের পর থেকে গত দু’দশক ধরে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে রক্ষনশীল বামপন্থী সরকার। এই দুই দশকে পেসোর বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে তারা যেসসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
এর ফলে পেসো দিয়ে ডলার কেনা আরো কঠিন হয়ে গেল। আর্জেন্টিায় বর্তমানে এক ডজন এক্সচেঞ্চ রেট হয়েছে। এটা নির্ভর করছে কারা এবং কেন ডলার ক্রয় করতে চায় তার ওপর।
অফিসিয়াল মূল্য অনুসারে, বর্তমানে এক ডলারের জন্য ২৮৭ পেসো প্রদান করতে হয়। তবে এখানেও আছে নানা শর্ত। একজন ক্রেতা মাসে ২০০ ডলারের বেশি ক্রয় করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, পেসোকে ডলারে রূপান্তরের লেনদেনের জন্যও ক্রেতাকে কর দিতে হবে।
পেসোকে ডলারে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে শুধু এই একটি প্রক্রিয়াই নয়। রয়েছে আরো কতিপয় উদ্ভট নীতিমালা।
এর মধ্যে একটি হলো ‘কোল্ডপ্লে ডলার রেট’ এবং অপরটি ‘মেলবেক রেট’। যেসব বিদেশী রক ব্যান্ড আর্জেন্টিনা ভ্রমণে আসে তাদের জন্য ‘কোল্ডপ্লে রেট’ প্রযোজ্য, যেখানে এক ডলারের বিনিময় মূল্য ৩৭৪ পেসো। এছাড়া রফতানি বৃদ্ধি করার জন্য মেলবেক রেট, যেখানে এক ডলারে ৩৪০ পেসো দেয়া হয়।
ব্রাজিলের ভিন্ন অভিজ্ঞতা
এত কিছুর পরেও আর্জেন্টিনার মানুষ ডলারের জন্য ব্যাকুল। ডলারে মূল্য পরিশোধ করলে দেশটির ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে একজন রেস্টুরেন্ট মালিক- সবাই সাদরে তা গ্রহণ করে।
এসব কিছুই ডলারাইজেশন চালু করার জন্য কাঙ্খিত হলেও বিষয়টি আসলে এমন হওয়া ঠিক নয়। এটা আসলে এভাবে হয় না। আর্জেন্টিনার শক্তিশালী প্রতিবেশী ব্রাজিল এ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল এবং তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছিল।
ডলারের বিপরীতে ব্রাজিলের মুদ্রার যেন বড় ধরনের উঠা-নামা না করে তার জন্য নিয়ম চালু করেছিল। অন্য অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণও ব্রাজিলকে সহায়তা করেছিল যেন ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি না হয় এবং ডলারের প্রতি তাদের কোনো মোহ না জন্মায়।
শত আবেদন করার পরেও ব্রাজিলের কোনো দোকান থেকে নগদ ডলার দিয়ে আপনি কিছু কিনতে পারবেন না। একবার সাও পাওলোতে এক রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্য প্রদান করতে গিয়ে নিরূপায় হয়ে ডলারের মাধ্যমে মূল্য গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কেননা তাদের ক্রেডিট কার্ড মেশিনটি ভেঙে গিয়েছিল। ডলারের মাধ্যমে মূল্য প্রদান করার প্রস্তাব করার জন্য দোকানের মালিক আমাকে আটকে রেখেছিল। পরে আমার বন্ধুকে ফোন করে করে ডেকে আমার বিল দিয়ে যেতে হয়েছিল।
বর্তমান উভয় দেশ ৯০-এর দশকে করা ওয়ান টু ওয়ান বিনিময় হার নীতি থেকে অনেক দূরে আছে।
আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র দেশ নয় যেখানে ডলারকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করতে চায়। এর আগে ইকুয়েডরের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থার পরিবর্তে ডলার প্রচলন হয়েছে এবং তাদের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে।
সূত্র : বিবিসি