পুরো বিশ্ব প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানির মতো দেশগুলো করোনার হানায় নাস্তানাবুদ। করোনাভাইরাস পৌঁছে গেছে বিশ্বের ২০৩টি দেশে। তবে একনায়ক কিম জং-উনের দেশ উত্তর কোরিয়ার এখনো কেউ আক্রান্ত হয়নি প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে।
আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়া সরকারের দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়েছে, করোনা ঠেকাতে জানুয়ারির শুরু থেকে সকল সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়াও ছিন্ন করা হয়েছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক এবং পিয়ংইয়ংয়ে কূটনৈতিকদের রাখা হয়েছে এক মাসের কোয়ারেন্টিনে।
এখন পর্যন্ত দেশটির কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি বলেও ওই বার্তায় বলা হয়েছে।
কেউ করোনা আক্রান্ত না হওয়ার এই তথ্য আসলেই কি সত্য? সত্যিই কি তারা এত ভাগ্যবান? নাকি উদ্বিগ্নতা এড়াতে ঘটনা গোপন রাখছে উত্তর কোরিয়া সরকার? নাকি উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে তথ্য না থাকায় এমন দাবি করছে দেশটি? এই সন্দেহমূলক প্রশ্ন তুলে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার অবিচ্ছিন্ন সীমান্ত রয়েছে এবং দেশটির বহির্বাণিজ্যের ১০০ ভাগের ৯০ ভাগ বাণিজ্যই হয়ে থাকে চীনের সঙ্গে। এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকার কথা উত্তর কোরিয়ারই। এরপরেও উত্তর কোরিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনো খবর জানা নেই আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমের।
উত্তর কোরিয়ার চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করা হারবার্ড মেডিকেল স্কুল এর লেকচারার ডা. কী বি. পার্ক বলেন, ‘যদি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ দেখা দেয়, তবে উত্তর কোরিয়ার স্বাস্থ্য খাত একদম ভেঙে পড়বে।’
তিনি আর দাবি করেন, ‘তাদের অনেকেই হয়তো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু তারা জানে না কীভাবে এটা শনাক্ত করতে হয়। তাই তারা শনাক্ত করতে পারছে না এবং বলছে, এখানে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।’
উত্তর কোরিয়ার বিদ্রোহীদের সিওল-ভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি-জেনারেল সিও জায়ে-পিয়ং বলেছেন, ‘যখন তারা বলছে যে তাদের কেউ আক্রান্ত নয় তখন এটি একটি স্পষ্ট মিথ্যা।’
তিনি আরও জানান, উত্তর কোরিয়া থেকে এক সূত্রে তিনি তথ্য পেয়েছেন মার্চের মাঝামাঝি পূর্ব উপকূলের শহর চঙ্গজিনে ভাইরাসজনিত কারণে প্রবীণ দম্পতি এবং এক পরিবারের তিনজন মারা গেছেন।
গত মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম ডেইলি এনকেতে নাম না প্রকাশের শর্তে একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় ২০০ জন সেনাসদস্য এবং আর ২৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
এর পরেই গত ১৭ মার্চ পিয়ংইয়ংয়ে একটি জেনারেল হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন কিম জং উন, যা অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিওল-ভিত্তিক ডিপিআরকে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান অহান কিউং-সু বলেন, ‘এটা ঠিক যে উত্তর কোরিয়ায় করোনা আক্রান্ত রয়েছে, তবে আমি মনে করি না যে এর প্রাদুর্ভাব আমরা দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত বড় আকারে দেখেছি ততটা বড় আকারের আছে। উত্তর কোরিয়ানরা সঙ্কটের সময় সরকারি আদেশ মানতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তবে ভাইরাসটি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
উত্তর কোরিয়ার সরকারি বার্তায় বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরা ছড়িয়ে পরলেও আমাদের দেশে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। করোনা ঠেকাতে আমরা বাস, ট্রাম, খেলার মাঠসহ শহরের সর্বত্র জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছি। আমাদের যারা কোয়ারেন্টিনে আছে তাদেরকে খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
তবে সরকারের এমন বার্তার বিপরীতে বক্তব্য দিয়েছেন দেশটির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের (এনআইএস) সাবেক প্রধান নাম সুং-উক। তার দাবি, আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে অবশ্যই কেউ না কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। হয়তো সরকারের সেদিকে খেয়াল নেই বা জেনেও অস্বীকার করা হচ্ছে।
এর পেছনে ওই প্রফেসরের যুক্তি, উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে অসংখ্য লোক ট্রাকে বা ট্রেনে করে দুই দেশের সীমান্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। তাই করোনাভাইরাস সহজেই উত্তর কোরিয়াতেও পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এদিকে, চীনের প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ায় করোনাভাইরাস প্রবেশ করলে তা মোকাবিলা করতে তারা ব্যর্থ হবে বলে মনে করেন উত্তর কোরিয়ার চিকিৎসক চোই জুং-হুন।
সফটওয়্যার সল্যুশন কোম্পানি ‘ডারাক্সে’র পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ওয়ার্ল্ডোমিটারে’ প্রকাশিত তথ্যমতে, চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ২০৩টি দেশ ও দুটি আন্তর্জাতিক প্রমোদতরীতে। ভাইরাসটির সংক্রমণে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ হাজার ৩৪৫ জন। সারা বিশ্বে আট লাখ ৬০ হাজার ১৮৪ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬৮ জন।