প্রায় আড়াই মাস পর নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের দিন তালা ভেঙে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এখন আবার নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামার চিন্তা করছে বিএনপি। তবে দলটির
তবে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দাবি করছেন, যে নির্বাচন হয়েছে সেই নির্বাচন জনগণ বর্জন করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া আওয়ামী লীগ জোর করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের যে আহ্বান জানিয়েছিল, তাতে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোট বর্জন করেছে।
তারা মনে করছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে জনগণ বিরোধী দলগুলোকে ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে। সেই ‘ম্যান্ডেট’ নিয়ে নতুন উদ্যমে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের দিন জনগণ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। যে নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, সেই নির্বাচন জনগণ মেনে নেয়নি। জনগণের ভোট হয়নি। সরকার পদত্যাগ করার পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হবে, সেটা হবে জনগণের নির্বাচন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’
সংসদ নির্বাচনের পরদিন গত সোমবার প্রথমবারের মতো গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি নেতারা। সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন তারা। এরপর গত মঙ্গলবার নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় ও নতুন কর্মসূচি নির্ধারণে রাজপথের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বৈঠকে সমমনা দলগুলোর নেতাদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেলে প্রথমে ১২-দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে, সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও শেষে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। বৈঠকে বিএনপি নেতাদের মধ্যে অংশ নেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাউদ্দিন আহমেদ ও বেগম সেলিমা রহমান।
পরের দিন বুধবার নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ, গণফোরাম (মন্টু), পিপলস পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, গণ অধিকার পরিষদের (ফারুক হাসান) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভোট বর্জনের আন্দোলন সফল হয়েছে। দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়নি বলে দলটি মনে করে। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও জনগণের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে বিএনপির নেতারা জানান।
গত বৃহস্পতিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। এদিন সকালে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে দলটির নেতাকর্মীরা তালা ভেঙে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্য়ালয়ে প্রবেশ করেন। গুলশান কার্যালয়ের পর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকেন নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা এক একটি ধাপ অতিক্রম করছি। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি আমরা প্রথমে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয়, সে জন্য কাজ করেছি। তাতে আমরা সফল হয়েছি। এরপর নির্বাচন বর্জনে জনগণের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছিলাম তাতে সফল হয়েছি। জনগণ ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে যায়নি।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, এখন বিরতি দিয়ে নতুন আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি নির্ধারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন এবং মতামত নিচ্ছেন তারা। পরবর্তী ধাপের আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিগগিরই নতুন কর্মসূচি নিয়ে তারা আবার মাঠে নামবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলতে থাকবে। এর অংশ হিসেবে এখন সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলতে থাকবে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পর দলটি ভোট ডাকাতির অভিযোগ তোলে দাবি করে, ‘দিনের ভোট রাতে হয়েছে’। তারা প্রথমে সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে যোগ দেয়। তবে তারা আর সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয়। প্রায় দুই বছর ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সংসদ থেকে পদত্যাগ, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশ ও মহাসমাবেশের কর্মসূচি পালন করে আসছিল দলটি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি, নতুন শ্রমনীতির মতো পদক্ষেপ ঘোষণা করে। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের আহ্বানও জানায় দেশটি।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর কঠোর আন্দোলনে যায় দলটি। তবে শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, মামলা ও পুরনো মামলায় একের পর এক সাজা দেওয়ার ঘটনায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিএনপি। এর পাশাপাশি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাও বাড়ে।
১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুদিন আগেও শর্তহীন সংলাপে বসতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সব চাপ এড়িয়ে সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করলে বিএনপি বর্জনের ঘোষণা দেয়। নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ২৮টি দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
আন্দোলন সফল না হওয়ায় এবং একই সঙ্গে নির্বাচনে না যাওয়ায় বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। খুলনা অঞ্চলের একটি ইউনিয়নের বিএনপির নেতারা দেশ রূপান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দলটির নির্বাচনে যাওয়া উচিত ছিল।
এখন বিএনপির সামনে বিকল্প শুধু আন্দোলন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির সমালোচনা করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিএনপির আন্দোলন ভুয়া। দলটিকে আবার পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে জনগণ আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দেয়নি। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন।’ তিনি মনে করেন, বিএনপির ওপর জনগণ যে দায়িত্ব দিয়েছে তা পালন করতে না পারলে জনগণ বিকল্প খুঁজবে। প্রয়োজনে নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটবে। তিনি বলেন, ‘সরকার মানুষ চায় না। তারা জোর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। এ কারণে বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে, তাতে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা শিগগিরই ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে।’