বিএনপি নেতারা সত্যিকারে ভারতীয় পণ্য বর্জন করছেন কিনা জানতে চেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নেতারা তাদের বউদের কাছ থেকে কেন ভারতীয় শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দলটির আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি’র এক নেতা চাদর খুলে আগুন দিচ্ছেন যে ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করবেন না। এরপর আবার দেখা গেল কিছু চাদর কিনে এনে পোড়ানো হলো। আচ্ছা শীতকাল তো চলে গেছে এখন আর চাদর পোড়ালে কী এসে যায়? শেখ হাসিনা বলেন, আমার প্রশ্ন যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করছেন, তাদের বউদের ক’খানা ভারতীয় শাড়ি আছে। তাহলে বউদের কাছ থেকে কেন শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না। আপনারা সবাই একটু বিএনপি নেতাদের এ কথাটা জিজ্ঞেস করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, বিএনপি নেতাদের বলবো, যারা যারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করবেন সবাই বাড়িতে গিয়ে তাদের বউরা যেন কোনোমতে কোনো ভারতীয় শাড়ি না পরেন, আলমারিতে যে ক’টা শাড়ি আছে সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করবো আপনারা সত্যিকারে ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন। বিএনপি নেতারা কি ভারতীয় মসলা ব্যবহার বন্ধ করতে পারবেন, এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে গরম মসলা, পিয়াজ, ভারত থেকে আমরা পিয়াজ আমদানি করছি, রসুন-আদা, মিজোরাম থেকে আমরা আনি, মসলাপাতি, ভারত থেকে যা কিছু আসছে তাদের কারও রান্নাঘরে যেন এ ভারতীয় মসলা দেখা না যায়। তাদের মসলা ছাড়া রান্না করে খেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি নেতাদের পেলে তাদের বউদের শাড়ির কথা আর মসলার কথা বলবেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাঙালির ওপর যে আক্রমণ চালিয়েছিল বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়া সেই আক্রমণকারীদের একজন ছিলেন বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, আজকে যারা প্রশ্ন করেন, আওয়ামী লীগ কোথায় ছিল? আমি জিজ্ঞেস করি, আপনারা কোথায় ছিলেন? সেটাও একটু বলেন। জবাব দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোথায় ছিল তাও আমি বলি, ২৫শে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন এখানে গণহত্যা শুরু করে, তারা কিন্তু চট্টগ্রামেও হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল। যারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে, তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আর চট্টগ্রামে সেই সেনাবাহিনীর দায়িত্বে জিয়াউর রহমান ছিলেন এবং জিয়াউর রহমানও যারা সেই সময় ব্যারিকেড দিয়েছে তাদের ওপর গুলি চালিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, শুধু তাই না, সোয়াত জাহাজ এসেছে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র নিয়ে, সেই অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সেখানে এই যে সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও অন্যান্য সাধারণ জনগণ, তারা তাকে পথে আটকায়। তাকে যেতে দেয়নি, বাধা দিয়েছিল এবং সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আসে। সেই সময় আমাদের নেতারা; এখন তো অনেকেই বেঁচে নেই! তারা এখনো সেটা স্মরণ করে। তিনি বলেন, কাজেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ যে আক্রমণটা বাঙালির ওপর চালায়, সেই আক্রমণকারী একজন কিন্তু জিয়াউর রহমানও। সেটা হলো চট্টগ্রামে। এটাও ভুললে চলবে না। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম ২৬শে মার্চ দুপুর ২টা-আড়াইটার সময় মান্নান সাহেব, চট্টগ্রামের সেক্রেটারি ঘোষণা দেয়া শুরু করে। একে একে আমাদের যারা নেতা সবাই ঘোষণা পাঠ করে। সে সময় জহুর আহমেদ সাহেব বলেন, আমাদের একজন মিলিটারি লোক দরকার। তাহলে আমরা যে যুদ্ধ করছি, সেই যুদ্ধ যুদ্ধ হবে। তখন মেজর রফিককে বলা হয়, তিনি তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আটকানোর জন্য অ্যাম্বুস করে বসে আছেন। বলছেন, আমি এখান থেকে নড়লে এই জায়গাটা ওরা দখল করে নেবে।
তিনি বলেন, ওই সময় জিয়াউর রহমানকে ধরে আনা হয় এবং তাকে দিয়ে ২৭ তারিখ সন্ধ্যার পরে সে জাতির পিতার পক্ষে ঘোষণাটা দেয়া হয়। তিনি পাঠ করেন। কেউ যদি কিছু বলে, আমরা আওয়ামী লীগ তাকে খাটো করে দেখেনি। জিয়াউর রহমান একজন মেজর, তিনি যখন বলছেন মানুষের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবটা আসবে, এই উদ্দেশ্য নিয়েই একজন সামরিক অফিসারকে দিয়ে এই ঘোষণা পাঠ করানো হয়েছিল। সেটাকেই এখন একেবারে ঘোষক হিসেবে (বলা হচ্ছে); হ্যাঁ, রেডিওর ঘোষক, টেলিভিশনের ঘোষক, আমাদের এই মিটিংয়েরও তো ঘোষক আছে, তাই না? ঘোষক তো সেই ঘোষক। কাজেই এটা নিয়ে বড়াই করার তো কিছু নেই! কিন্তু তারা এটা (নিয়ে) বড়াই করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আমি একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সে সময় পাকিস্তানি সামরিক অফিসার আসলাম বেগ বাংলাদেশে কর্মরত ছিল। পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধানও হয়েছিল সে। এই আসলাম বেগ একটা চিঠি লিখেছিল জিয়াউর রহমানের কাছে। সেই চিঠিতে জিয়াউর রহমানের কার্যক্রমে সে সন্তুষ্টি জানিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, আসলাম বেগ আরও লিখেছেন, “সে তার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট, তাকে ভবিষ্যতে আরও কাজ দেয়া হবে। জিয়ার পরিবার তার স্ত্রী ও দুই ছেলে যে ভালোভাবে আছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেই কথাটাও চিঠিতে জানিয়েছে। চিঠিটার কপিটা ছিল, পার্লামেন্টেও পাঠ করা হয়েছে। এটা ডকুমেন্ট হিসেবেও আছে।” তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমাদের গেরিলারা বিভিন্ন সেনা অফিসারদের পরিবারগুলোকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। তারা খালেদা জিয়ার কাছেও এসেছিল কিন্তু তিনি গেরিলাদের সঙ্গে না গিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান। শেখ হাসিনা প্রশ্ন রাখেন, যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ফেললো, তার বউ ছেলেকে হেফাজতে রেখে দিলো পাকিস্তানিরা আর আসলাম বেগ চিঠিতে জানালো জিয়ার কার্যক্রমে তারা সন্তুষ্ট, কেন সন্তুষ্ট জানেন? যতগুলো সেক্টরে যুদ্ধ হয়েছে, আপনারা হিসাব করে দেখেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সব থেকে বেশি হত্যা করা হয়েছে যেটার দায়িত্বে ছিল জিয়াউর রহমান। সব থেকে বেশি হতাহত ছিল সেখানে। স্বাধীনতার ঘোষণার ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই ইতিহাসকে পঁচাত্তরের পর তো বিকৃত করা হয়েছে। বিকৃত করে একটা ভিন্ন ইতিহাস সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল একটা মেজর কোনো ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ফুঁক দিলো আর অমনি বাঁশি ফুঁক দিলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। এইভাবে একটা দেশ স্বাধীন হয় না। তাহলে তো বাংলাদেশে ইতিহাস অন্য রকম হতো। এই ক্ষেত্রে আমি বলবো যে, এই যে ইতিহাস বিকৃত করে এখনো তারা কিন্তু ভাঙা রেকর্ডের মতো বলেই যাচ্ছে। ওদের কখনো আক্কেল ঠিকানা হবে না। আর না হওয়ার কারণও আছে। এখন তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। এর মধ্যে অনেকেই তো…মুক্তিযুদ্ধে তারা কে ছিলেন? কোথায় ছিলেন? আজকে যিনি বলেছেন যে, ২৫শে মার্চ সব আওয়ামী লীগ পালিয়ে গিয়েছিল, তার বাবা কে ছিলেন?
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ’৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়, তখন খাদ্য সচিব ছিলেন। এই খাদ্য সচিব বেইমানি করে ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েছিলেন। যার পুরস্কার পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান যখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। তাকে উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন মন্ত্রীর মর্যাদায় এই মঈন খানের বাবা। তার নাম হলো মোমিন খান। তিনি ছিলেন খাদ্য সচিব পিএল ফরেটের ওপর আমরা নির্ভরশীল। সেই পিএল ফরেট জাহাজ, নগদ টাকা দিয়ে কেনা জাহাজ। সেই জাহাজ ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। খাবার আসতে দেয়নি বাংলাদেশে। দুর্ভিক্ষ ঘটানো হয়েছিল। মুজিবনগর সরকার গঠন করে শপথ নিয়ে তারা যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। সরকারপ্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার গ্রেপ্তারের পর উপ-রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সেই সরকারের অধীনে এ দেশে যুদ্ধ হলো।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জিয়াউর রহমান তো বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে চাকরি করেছেন। সামরিক অফিসার হিসেবে তিনি এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হলেন, সেটা কে দিয়েছেন? আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। এটাও অকৃতজ্ঞরা ভুলে যায়। প্রধানমন্ত্রী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করে বলেন, এ বুদ্ধিটা যখন অন্য খাতে চলে যায় তাদের মতিভ্রম হয়ে যায় তখন আর এর কোনো দাম থাকে না, সেটা নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
তিনি বলেন, বিএনপি গণতন্ত্র খুঁজে বেড়ায়। কোথায় পাবে তারা গণতন্ত্র? তাদের চোখে তো স্বৈরতন্ত্রের ঠুলি পরানো। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর দেশে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রতি রাতে কারফিউ বলবৎ থাকতো। এমনকি তিনি ’৮১ সালে দেশে ফেরার পরও দেখতে পান রাত এগারোটার মধ্যে ঘরে ফিরতে হচ্ছে, সারারাত কারফিউ। এটাকে ‘কারফিউ গণতন্ত্র’ বা ‘মার্শাল ল’ গণতন্ত্র আখ্যায়িত করে বিএনপি এখন সে গণতন্ত্রই খুঁজে বেড়ায় কিনা সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত কাণ্ড আমরা দেখি- অতি ডান (ডানপন্থি) ও অতি বাম (বামপন্থি) তারা এখন এক জায়গায় হয়ে গেছে। তাদের আদর্শটা কি? তাদের নীতিটা কি? তারা কোনো কিছুতেই ভালো খুঁজে পায় না। অতি বামে বেশ কিছু দল আছে তারা একেবারে বিপ্লব করবে। যে বিপ্লব করতে করতে তারা এখন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা প্রতিবেশীসহ অনেক দেশের সহায়তা পেয়েছি। আবার অনেক বড় দেশের বৈরিতা পেয়েছি। অবশ্য সে দেশের নাগরিকদের সমর্থনও পেয়েছি। যারা আমাদের স্বাধীনতায় সহায়তা করেছে, তাদের আমরা সম্মানিত করেছি, স্বীকৃতি দিয়েছি। একমাত্র বাংলাদেশই এটা করেছে। এতে বাংলাদেশও সম্মানিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বিজয় এনে দেয়া জাতির পিতার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল বলে সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলা, সবই তিনি করেছেন। এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করেছি, এর ২৯ বছর ছিল জাতির দুর্ভাগ্যের। স্বাধীনতার পরপরই মাত্র তিন বছরে একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলেন শেখ মুজিব। আইন, নীতিমালাসহ সবকিছু করে দিয়ে যান। একটি সংবিধান আমাদের উপহার দিয়েছেন। এতে আমাদের প্রতিটি অধিকারের কথা বলা আছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক ও শাজাহান খান, দলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, ঢাকা জেলা সভাপতি বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি প্রমুখ আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেন। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও সহ প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আওয়াল শামীম।