‘এবারের ঈদ গেছে আমাদের চোখের পানিতে। রোজা আর ঈদের দিন কেটেছিল প্রিয়জনের প্রাণ ফিরে পাওয়ার দোয়া চেয়ে। কাল ঘরে ফিরবে আমার স্বামী। আমাদের ঈদ কালকে।’
কথাগুলো বলছিলেন, বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া এমভি আব্দুল্লাহ’র জেনারেল স্টুয়ার্ড নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।
তাই মঙ্গলবারের দিনটিকে ঘিরে রাজ্যের প্রস্তুতি চলছে তাদের বাড়ি জুড়ে। এখন অপেক্ষা শুধু প্রিয়জনের ঘরে ফেরার।
ঠিক এক মাস আগে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়া এমভি আব্দুল্লাহ বাংলাদেশের কুতুবদিয়ায় নোঙ্গর করেছে সোমবার সন্ধ্যায়। কিন্তু দেশে ফিরলেও স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ মিলবে আরো একদিন পর।
কিন্তু মুক্ত হওয়ার এতদিন পর দেশে ফেরার পরও স্বজনদের এই অপেক্ষা কেন?
জবাবে জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপ বলছে, জাহাজটিতে ৫৩ হাজার মেট্রিকটন চুনাপাথর রয়েছে। পণ্য বোঝাই থাকার কারণে এটি সন্ধ্যায় কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নোঙ্গর করেছে।
কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম জানান, কুতুবদিয়ায় আসার পর নাবিক ও ক্রুর একটি নতুন ব্যাচ জাহাজটিতে পাঠানো হবে। জাহাজে বর্তমানে যে ২৩ জন ক্রু আছেন তাদের আগামীকাল মঙ্গলবার একটি লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রামে আনা হবে।’
সোমবার রাতে কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম জানান, নাবিকদের নিয়ে মঙ্গলবার জাহাজটি পৌছাবে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-১ এ।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ ম্যার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো: আনাম চৌধুরী বলেন, জাহাজ যেহেতু ফুল লোড নিয়ে আসছে এ কারণে সরাসরি এটি জেটিতে ঢুকতে পারছে না।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষ হচ্ছে ২৩ পরিবারের
চট্টগ্রামে পৌছানোর পর কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না। তবে, বন্দীদশা থেকে মুক্ত নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা থাকবেন স্বজদের বরণ করতে।
ওই ২৩ নাবিকের সাথে সাক্ষাতের এই ক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন জানিয়েছে অন্তত তিনজন নাবিকের পরিবারে সদস্যরা।
ইঞ্জিন ক্যাডেট তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন,‘আজ সকালে ছেলের সাথে কথা হয়েছে। কাল চট্টগ্রামে পৌঁছালে ছেলেকে আনতে যাবো।’
তিনি বলেন, আমার ছেলে যে জায়গা থেকে ফেরত এসেছে এটা তো একটা নতুন জীবন পাওয়ার মতো আনন্দ। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমি শুধু অপেক্ষা করছি।
প্রিয়জনের বাড়ি ফেরা নিয়ে অপেক্ষার অবসান যেন হচ্ছেই না। বরণ করে নিতে নানা পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছিলেন এমভি আব্দুল্লাহ’র জেনারেল স্টুয়ার্ড নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।
তিনি বলেন,‘উনি আসবে তাই সব কিছু অ্যারেঞ্জ করতে সারাদিন কাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ওনার যা যা পছন্দ কাল ওগুলো সব রেডি করবো। এগুলোর জন্য আমরা রেডি হচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন,‘এত খারাপ সময় আমার জীবনে আমরা কোনোদিন পাইনি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি এত দুঃসময় আর কোনদিন জীবনে না আসুক।’
জাহাজটিতে থাকা চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই আসিফ খান জানান,‘কাল ঠিক কোন সময় এসে জাহাজটি পৌঁছাবে সেটা এখনো ঠিক জানি না।’
কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম।বলেন, কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌছাতে অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। যদি সকাল নাগাদ রওনা দেয় তাহলে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা।’
কুতুবদিয়া নোঙ্গর করেছে এমভি আব্দুল্লাহ
২৩ নাবিকসহ জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ প্রায় এক মাস পর বাংলাদেশে নোঙ্গর করেছে। সোমবার সন্ধ্যায় জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় এসে নোঙর করে।
জাহাজে থাকা জেনারেল স্টুয়ার্ড নুর উদ্দিন সোমবার বিকেলে কুতুবদিয়ায় পৌঁছানোর কথা জানান।
জাহাজের মালিক কর্তৃপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজ রাতে সেখানেই থাকবে নোঙ্গর করা অবস্থায়। নোঙ্গর করার পরই জাহাজটিতে থাকা চুনাপাথর খালাস শুরু হয়েছে।
আগামী দুই দিন জাহাজটি থেকে পণ্য খালাস করার পর এটিকে বন্দরের আউটার বারে নিয়ে আসা হবে। কেননা পণ্যসহ এত গভীরতার জাহাজ সরাসরি বন্দরের কাছাকাছি যেতে পারে না।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ ম্যার্টেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চৌধুরী বলেন, ‘জাহাজে পণ্য বোঝাই থাকার কারণে জাহাজটি এই মুহূর্তে সরাসরি বন্দরে আনা সম্ভব হচ্ছে না।’
যেভাবে ফেরত আনা হবে নাবিকদের
অপহরণের দীর্ঘ ১ মাস পর গত ১৩ এপ্রিল সোমালিয়ার সময় রাত ১২টা এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় মুক্তি পায় এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিক।
মুক্তির পর জাহাজটি ২২ এপ্রিল কয়লা খালাসের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে চুনাপাথর আমদানির জন্য শনিবার মিনা সাকার বন্দরে যায়।
সেখানে দুই দিনের মধ্যে ৫৩ হাজার মেট্রিকটন চুনাপাথর লোড করে জাহাজটি গত ১৪ দিন আগে বাংলাদেশের উদ্দেশে রাওনা হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়া আসার পর নাবিক ও ক্রু সদস্যদের একটি নতুন ব্যাচ জাহাজটিতে পাঠানো হবে। জাহাজে বর্তমানে যে ২৩ জন ক্রু আছেন তাদের আগামীকাল মঙ্গলবার একটি লাইটারেজ জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের এনইটি টার্মিনালে আনা হবে।
মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম।বলেন,‘কাল যদি আবহাওয়া ঠিক থাকে তাহলে তাদেরকে আরেকটি লাইটারেজ জাহাজ নামিয়ে নিয়ে আসবো। ওনাদের সবাইকে একসাথে এনে ওনাদের কিছু ইমিগ্রেশনের ফরমালিটিস আছে সেগুলো কম্পিলিট করা হবে।’
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে বন্দীদশা থেকে মুক্ত ২৩ নাবিককে নিয়ে আসা লাইটারেজ জাহাজটি নোঙ্গর করবে চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার কেএসআরএম গ্রুপের নিজস্ব জেটিতে।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম বলেন,‘ওখানে নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা থাকবে। তবে সেখানে আনুষ্ঠানিক কোনো আয়োজন থাকবে না।’
বিমানে ফিরতে চেয়েছিল ২ নাবিক
সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ার প্রায় এক মাস বন্দী অবস্থায় ছিল এমভি আব্দুল্লাহ ও জাহাজটিতে থাকা ২৩ নাবিক।
প্রায় ৩৩ দিনের এই বন্দীদশায় অনেক নাবিকই যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবারের সদস্যদের সাথে। একপর্যায়ে জাহাজের খাবার ও পানির কিছুটা সঙ্কট দেখা যায়।
তখন জাহাজটিতে থাকা নাবিকরা তাদের পরিবারকে সেই সময়ের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানান। তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানান।
পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে ঠিক এক মাস আগে গত ১৩ এপ্রিল মধ্যরাতে জাহাজটি থেকে নেমে যায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এরপরই কয়লা বোঝাই জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে পৌছায় গত ২২ এপ্রিল।
সেখানে জাহাজটির মালিকপক্ষও দেখা করে নাবিকদের সাথে।
কেএসআরএম গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানান, ওই সময় জাহাজের ২৩ নাবিকের মধ্যে দুই জন ক্রু ওই জাহাজে না এসে দুবাই থেকে বিমানে ফিরতে চেয়েছিলেন।
তারা হলেন জাহাজের জেনারেল স্ট্রুয়ার্ড নুর উদ্দিন ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার।
সোমবার জেনারেল স্ট্রুয়ার্ড নুর উদ্দিনের স্ত্রী জানান,‘জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর আমার স্বামী ম্যান্টালি ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মালিকপক্ষ ওখানে যখন গেছে, তাদের সাথে কথা বলেছে, তখন আস্তে আস্তে সে সবার সাথে জাহাজে আসতে রাজি হয়েছে।’
কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম।বলেন, আমরা সবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই ২৩ জনের মধ্যে ২১ জনই জাহাজে আসতে চেয়েছেন। তখন সবার সাথে কথাবার্তা হলো তখন ওনারা সবার সাথে আসতে রাজি হয়েছে।’
বন্দীদশা থেকে মুক্তির পর ওই ক্রুদের দিয়েই একই জাহাজে আবারো নতুন করে পণ্য আমদানি করা হয়েছে বাংলাদেশে। এটি কতখানি যৌক্তিক?
এমন প্রশ্নে করিম জানান, এটা শিপিংয়ের জাহাজ, ভাড়া দিয়ে চলে। এখানে কমেন্ট করার কিছু নাই। ওনাদের সাথে আমাদের চুক্তি আছে। আমাদের সিস্টেমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।’
বাংলাদেশ বাংলাদেশ ম্যার্টেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চৌধুরী বলেন,‘আমার মনে হয় ক্রুদের সম্মতি নিয়েই ওখানে গেছে। ওখানে গিয়েই ওরা কার্গো বাঙ্কার করে এখন চলে আসছে। এটা যদি স্বল্প দূরত্বের পথ হতো তাহলে চলে আসতে পারতো। কিন্তু এটা তো দীর্ঘ পথ।’
বন্দীদশা থেকে দেশে ফেরা
৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে এমভি আব্দুল্লাহ গত ৪ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা হয়। ১৯ মার্চ আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে জাহাজটির পৌঁছানোর কথা ছিল।
মাপুতু থেকে রওনা হওয়ার চার দিন পর গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল।
এরপর জলদস্যুরা মুক্তিপণ দাবি করে জাহাজ কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রায় ২০ দিন ধরে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা চলে জাহাজ কর্তৃপক্ষের।
এরপর মালিকপক্ষ হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিপণের ফেলে দিয়ে আসা দিয়ে। পণবন্দী হওয়ার দীর্ঘ ৩৩ দিন পর গত ১৩ এপ্রিল মধ্যরাতে জাহাজটি থেকে নেমে যায় সোমালিয়ান জলদস্যুরা। মুক্ত হয় ২৩ নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ।
মুক্ত হওয়ার আট দিনের মাথায় গত ২১ এপ্রিল বিকেলে নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ দুবাই পৌঁছে।
জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের জেটিতে ভিড়ে ২২ এপ্রিল। এরপর ওই বন্দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খালাসের পর নতুন ট্রিপের পণ্য চুনাপাথর লোড করতে ইউএই’র মিনা সাকার বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজটিকে।
সেখানে ৫৩ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে এমভি আব্দুল্লাহ গত ৩০ এপ্রিল দুবাই মিনা সাকার বন্দর থেকে দেশের পথে রওনা হয়।
সূত্র : বিবিসি