সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ অপরাহ্ন

হোটেল-রেস্তোরাঁয় ‘বিশেষ ডিসকাউন্ট অফার’ বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে

বিডি ডেইলি অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪
  • ৪৯ বার

বাংলাদেশে ঢাকা ও এর আশপাশের দুই ডজনেরও বেশি হোটেল এবং রেস্তোরাঁতে বিশেষ মূল্যছাড় পাওয়ার বিষয়ে পুলিশের একটি দাফতরিক চিঠি নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

সদর দফতরে পাঠানো ট্যুরিস্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তার ওই চিঠিতে ১২টি হোটেলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোতে থাকার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় পাবেন বলে জানানো হয়েছে।

হোটেলের সেই তালিকায় ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন এবং ঢাকা রিজেন্সির মতো বিলাসবহুল হোটেলের নামও পাওয়া যাচ্ছে।

সমঝোতা চুক্তি থাকার কারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে বিশেষ এই মূল্যছাড় দিচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

যদিও চুক্তির মাধ্যমে মূল্যছাড়ের মতো বিশেষ সুবিধা নেয়ার ঘটনা পুলিশ বাহিনীতে এবারই প্রথম নয়।

আগেও তারা বিভিন্ন সময় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হোটেল ও রেস্তোরাঁর সাথে চুক্তি করেছে এবং সুবিধা নিয়ে আসছে।

কিন্তু হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো পুলিশকে এই মূল্যছাড় কেন দিচ্ছে? আর দিলেই কি পুলিশ সেটি নিতে পারে?

চিঠিতে কী আছে?
গত ২৬ এপ্রিল চিঠিটি পাঠিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার নাইমুল হক।

সেখানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার ২৫টি হোটেল ও রেস্তোরাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যরা বিশেষ মূল্যছাড় পাবেন।

তালিকায় থাকা ১২টি হোটেলের মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ছয়টি।

সেগুলো হলো- রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, হোটেল হলিডে ইন, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, হোটেল সারিনা এবং হোটেল পূর্বানী।

এর বাইরে নারায়ণগঞ্জের দুটি এবং গাজীপুরের তিনটি হোটেল ও রেস্তোরাঁর নাম রয়েছে। তবে সংখ্যার দিকে থেকে তালিকায় সবচেয়ে বেশি ১৪টি হোটেল-রেস্তোরাঁর নাম রয়েছে মুন্সিগঞ্জ জেলার।

হোটেলে থাকার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় পাবেন বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে ১৩টি রেস্তোরাঁয় তারা ২০ শতাংশ হারে ডিসকাউন্ট পাবেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এর বাইরে, বেসরকারি একটি ট্রাভেল এজেন্সির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় পাবেন বলে চিঠিতে বলা হচ্ছে।

কিসের ভিত্তিতে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো এই মূল্যছাড় দিচ্ছে, সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।

সেখানে বলা হচ্ছে, ‘স্টেক হোল্ডারদের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এমওইউ’র (সমঝোতা চুক্তি) পরিপ্রেক্ষিতে’ ২৫টি হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং একটি ট্রাভেল এজেন্সির পক্ষ থেকে পুলিশকে বিশেষ মূল্যছাড়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

‘বাংলাদেশ পুলিশের সকল সদস্যগণ ভেলিড পুলিশ আইডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে ডিসকাউন্ট অফার উপভোগ করতে পারবে,’ চিঠিতে বলা হয়েছে।

কী বলছে পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ?
পুলিশ দাবি করছে যে- তারা আইন ভেঙে কোনো সুবিধা নিচ্ছেন না।

‘হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো এ ধরনের অফার অনেক প্রতিষ্ঠানকেই দিয়ে থাকে। এখানে নিয়ম ভাঙার কোনো বিষয় নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আবু কালাম সিদ্দিক।

কর্মকর্তারা বলছেন যে- মামলা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজে পুলিশকে প্রায়ই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হয়। অনেকক্ষেত্রে সেখানে রাতও থাকতে হয়।

এক্ষেত্রে অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো তারাও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা পেয়ে থাকেন।

‘কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় ওই টাকা দিয়ে তারা ডিসেন্ট কোনো জায়গায় থাকতে বা খেতে পারছেন না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পুলিশ সুপার বদরুল আলম।

মূলত সেই কারণেই হোটেল ও রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

‘হোটেল ও রেস্তোরাঁর সাথে চুক্তি থাকলে পুলিশ সদস্যদের একটু সুবিধা হয়। তারা একটু কম খরচে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পান,’ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন চিঠির প্রেরক ট্যুরিস্ট পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার নাইমুল হক।

তিনি আরো বলেন, ‘এটা অনেকটা কর্পোরেট চুক্তির মতো…সরকারি (কাজের) প্রয়োজনে এবং দায়িত্ব পালনের জন্য কোথাও গেলে পুলিশ সদস্যরা এ ধরনের সুবিধা পাবেন।’

এর আগে, ২০২২ সালেও হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের সাথে একই ধরনের চুক্তি সই করেছিল ট্যুরিস্ট পুলিশ।

তখন চুক্তি হয়েছিল কক্সবাজার জেলার আটটি হোটেল, চট্টগ্রাম জেলার আটটি হোটেল এবং পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় তিনটি হোটেলের সাথে।

এরপর থেকে ওইসব হোটেলে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় সুবিধা পেয়ে আসছে পুলিশ।

কিন্তু হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো কেন এই সুবিধা দিচ্ছে?
‘পারস্পরিক সম্পর্কের কারণেই আমরা এটি দিচ্ছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকার একটি হোটেলের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা।

প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের জায়গা থেকে অনেকেই এরকম মূল্যছাড় পেয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।

‘এক্ষেত্রে পুলিশের মতো একটি বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার পাবে। কারণ তারাই আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।

তবে সরকারি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এরকম সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

‘আচরণবিধি পরিপন্থী’
অন্যান্য স্থাপনার মতো বাংলাদেশের হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও পুলিশের উপর রয়েছে।

এমনকি, পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলাদাভাবে ট্যুরিস্ট পুলিশও গঠন করা হয়েছে।

মূলত তারাই পর্যটনখাত সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।

নিরাপত্তাবিধানের পাশাপাশি হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধেও পুলিশ বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

‘কাজেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা চুক্তির মাধ্যমে মূল্যছাড়ের মতো বিশেষ সুবিধা নিতে পারে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে, যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে টিআইবি’র দুই বছর আগের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

‘কাজেই হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো হঠাৎ কেন পুলিশকে বিশেষ সুবিধা দিতে গেলো, সেই প্রশ্নটি সামনে আসাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

‘এক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে কি না, সেটি পরিষ্কার হওয়া দরকার।’

‘একইসাথে, বিশেষ মূল্যছাড় দিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো পুলিশের কাছ থেকে বাড়তি কোনো সুবিধা নিচ্ছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের মাঝে মধ্যেই দূর-দূরান্তে যেতে হয়।

এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন চার শ’ টাকা থেকে শুরু করে গ্রেডভেদে প্রতিদিন ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত ভাতা পান সরকারি চাকরিজীবীরা।

ব্যয়বহুল শহরের ক্ষেত্রে এই ভাতা অতিরিক্তি ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়া প্রতিটি জেলায় সরকারের একাধিক অতিথিশালাও রয়েছে।

‘কিন্তু সেগুলো বাইপাস করে পুলিশ হোটেলে থাকছে কি না, সেটি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিৎ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

এদিকে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে- এমন কোনোপক্ষের কাছ থেকে পুলিশ সুবিধা নিতে পারে না বলে জানাচ্ছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।

‘তারা প্রয়োজনে সরকারের কাছে ভাতা বাড়ানোর দাবি জানাতে পারে। কিন্তু সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীই এরকম সুবিধা নিতে পারেন না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মজুমদার।

সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

‘কাজেই সেটি না মানায় স্পষ্টভাবেই এটি সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির লঙ্ঘন, বিধি পরিপন্থী কাজ। কারণ পুলিশের সাথে ওইসব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানের সরাসরি স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মজুমদার।

তাছাড়া পুলিশ এরকম সুবিধা নিলে সরকারি অন্য সংস্থাগুলোও সেই পথ অনুসরণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সাবেক এই আমলা।

‘তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। কাজেই সরকারের উচিৎ দ্রুত ঘটনাটি তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মজুমদার।
সূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com