ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট তার অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে রাঘববোয়ালদের কাছে পাঠাতেন মোটা অঙ্কের টাকা। বিভিন্ন মহলের প্রভাবশালীদের হাতে সম্রাটের এই ‘নজরানা’ পৌঁছে দিতেন তার সার্বক্ষণিক সহযোগী আরেক যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমান। সম্রাট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। ক্যাসিনোকা-ে গ্রেপ্তার হওয়ায় তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন সম্রাট।
জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র জানায়, সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া পরিচালিত ক্যাসিনোর টাকার ভাগ ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও পেতেন। এ ব্যাপারে সম্রাট রিমান্ডে বলেছেন, মেননকে তারা মাসে চার লাখ টাকা করে দিতেন। কোনো কোনো মাসে এর পাশাপাশি বাড়তি টাকার জন্যও চাপ দিতেন তিনি। র্যাব গত ১৮ সেপ্টেম্বর ইয়ংমেন্স ফকিরাপুল ক্লাব দিয়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে। মেনন এই ক্লাবের চেয়ারম্যান। আর সভাপতি ছিলেন খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া। অভিযান শুরুর পর সাংবাদিকরা মেননের কাছে জানতে চাইলে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ওই ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি তিনি জানতেন না।
সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ওই এমপির (মেনন) নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্যাসিনো চলছিল। এ জন্য সম্রাটের কাছ থেকে তিনি নিয়মিত টাকা নিতেনÑ এমন তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট স্বীকার করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমার সঙ্গে সম্রাটের আর্থিক কোনো সম্পর্ক নেই, নির্বাচন ছাড়া। ইলেকশনের সময় সে-ই (সম্রাট) খরচ করেছে যুবলীগের হয়ে, আমি করিনি। একপর্যায়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এসব তথ্য আপনারা কই পান। জিজ্ঞাসাবাদে বললেই হয়ে গেল?
জিজ্ঞাসাবাদ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজের পরিকল্পনা আর কর্মকা-ের বর্ণনা দিতে গিয়ে গতকাল আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সম্রাট। একপর্যায়ে তিনি কেঁদেও ফেলেন। তিনি জানান, শুধু ক্যাসিনোর জন্যই তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সম্রাট আরও জানান, তিনি সবাইকে ম্যানেজ করেই তার ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ অন্যান্য অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও রয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও কেউই তাকে রক্ষা করতে পারেনি। কীভাবে সবকিছু ঘটে গেল সেটি তার কাছে এখন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সম্রাটের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া কর্তাব্যক্তিদের নাম জানিয়েছেন তিনি। এসব ব্যক্তির বিষয়ে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ইউনিট।
জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, সম্রাট ও আরমান নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজে লাগাতেন কয়েকজন পরিচালক ও নায়ক-নায়িকাকে। এ জন্য বেশ কয়েকটি সিনেমায় প্রযোজক হিসেবে বিনিয়োগও করেন তারা। এসব পরিচালক, নায়ক-নায়িকার সম্পৃক্ততা ইতোমধ্যে উঠে এসেছে। সূত্র জানায়, খুব শিগগির তাদের কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্রাট ঢাকায় ক্যাসিনোবাণিজ্য পরিচালনার আদ্যোপান্ত তথ্য দিয়েছেন। কাদের কীভাবে কত টাকা দিতেন সেসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। তবে তদন্তের এই পর্যায়ে তাদের নাম প্রকাশ করতে চান না জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারা। এ ছাড়া সম্রাট নিয়মিত সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে সেন্ড ক্যাসিনো খেলতে যাওয়ার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। সিঙ্গাপুরে কীভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা নিতেন এবং প্রতিমাসে কত টাকা ক্যাসিনো খেলে ওড়াতেন সেসব বিষয়েও মুখ খুলেছেন তিনি। সম্রাটের সঙ্গে ক্যাসিনো খেলতে সিঙ্গাপুরে যেতেন কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সম্রাটের টাকা-পয়সার হিসাব রাখতেন আরমান। ঢাকায় কাদের কত টাকা দিতে হবে সেটি সম্রাট বলার পর আরমান বাস্তবায়ন করতেন। এ ছাড়া বিদেশে টাকা পাচারের জন্য সম্রাটকে সহায়তা করতেন আরমান ও কাউন্সিলর সাঈদ। সম্রাটের প্রায় সব বিষয়েই জানেন আরমান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সম্রাট ও আরমানের কাছ থেকে পৃথকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৃথকভাবে দেওয়া তাদের দুজনের তথ্য মিলে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকায় রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া কয়েক জন কাউন্সিলরের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়ানো কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র।
গত মঙ্গলবার সম্রাটের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অস্ত্র ও মাদক মামলায় ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার একটি আদালত। একই সঙ্গে তার সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক আরমানের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। প্রথমে সম্রাট ও আরমানকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এর পর গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে সম্রাট ও আরমানের মামলার তদন্তভার পুলিশের কাছ থেকে র্যাবে ন্যস্ত করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার তাদের দুজনকে নেওয়া হয় র্যাব-১ কার্যালয়ে। সেখানেই তাদের এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের নির্দেশে এই অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব। ইতোমধ্যে যাদের নাম এসেছে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আত্মগোপনে গিয়েছিলেন সম্রাট। নানা গুঞ্জনের পর ৭ অগাস্ট কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও আরমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সেদিন বিকালে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে তার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। এর পর রমনা থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে সম্রাট ও আরমানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করে র্যাব।