করোনা বিপর্যয়ের সূচনাকাল থেকে জোর দিয়ে প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে, ‘আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই কাম্য।’ বাস্তবে মানুষ এ ব্যাপারে যতটা সচেতন, এর চেয়ে ঢের বেশি আতঙ্কিত। তার চেয়েও বড় কথা, নানা ধরনের অপবাদ ও কলঙ্কের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এই আতঙ্ক ও অপবাদের কার্যকর মোকাবেলা না করে শুধু চিকিৎসা ও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে করোনা মহামারীর তাণ্ডবজনিত বহুমুখী ক্ষতি নিরসন কঠিন হতে পারে।
ব্রিটেনের সাসেক্স ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশের ‘ইউল্যাব’ ভার্সিটির দু’জন শিক্ষকের যৌথ গবেষণায় জানা যায়, করোনা জীবাণু নিয়ে এ দেশে মোট ছয় ধরনের আতঙ্ক ও অপবাদ পরিদৃষ্ট হয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত রোগী ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাসেবীরা অপবাদের সর্বাধিক শিকার। মূলত, আতঙ্ক বিরাজ করছে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই।
গবেষণাকর্মে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সংশ্লিষ্ট ভীতি-উদ্বেগ এবং অপবাদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ বিষয়টি ছয়টি পর্যায়ে ‘বিকশিত’। সর্বপ্রথম ধাপে এমন ভ্রান্ত নিরাপত্তার অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল যে, বাংলাদেশে করোনা মহামারী ছড়াবে না। দেশের মানুষ মনে করছিল, এটা অনেক দূরের অচেনা ব্যাধি এবং তাদের দেশের লোকজনের মন্দ খাদ্যাভ্যাস ও পাপের কুফল। তদুপরি, বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়াতে করোনাভাইরাস টিকবে না। দ্বিতীয়ত, জনমনে ‘প্রবাসী আতঙ্ক’ দেখা দেয়। এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রবাসে চাকরি, ব্যবসায় এবং নানা ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। তাদের একটা বড় অংশই করোনায় আক্রান্ত এবং তারা দলে দলে স্বদেশে ফিরেছেন। গত এক মাসে কয়েক হাজার প্রবাসীর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, যাদের মাধ্যমে দেশের বেশ কয়েক জেলায় ভয়াবহ করোনা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি জানান, আগামী দু’সপ্তাহে ২৮ হাজার প্রবাসী দেশে আসছেন। তৃতীয় পর্যায়ে সবাইকে করোনার সম্ভাব্য বাহকরূপে সন্দেহ করা হতে থাকে। অপর দিকে, দেশের কয়েকটি স্থানে বড় বড় সমাবেশ ঘটেছে। তৃণমূলস্তরে মানুষ এ বিষয়ে কত বেশি অসচেতন, তার প্রমাণ এটা। ফলে সচেতন নাগরিকরা স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। চতুর্থত, দিন যত গেছে, করোনা ততই ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় মানুষ পরস্পরকে এ জন্য দায়ী করে অপবাদ দেয়া শুরু করে দিয়েছে। এমনকি, কোনো কোনো এলাকায় অনেক দোকানে বোর্ডে লিখে জানিয়ে দেয়া হয়, ‘কোনো প্রবাসীর কাছে পণ্য বিক্রি করা হবে না।’ করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং এ রোগে কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফন ও নামাজে জানাজায় বাধা দেয়া হতে থাকে। পঞ্চমত, লকডাউন করা নিয়ে ভীতিমিশ্রিত বিভ্রান্তি দেখা গেছে। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন অনেকের মনেই আয় ও জীবিকা নিয়ে আতঙ্ক জন্ম নেয়। তা ছাড়া করোনাজনিত ‘কোভিড-১৯’ রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে অনাস্থা ও ভীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ষষ্ঠত, মোট মিলিয়ে অপবাদ ও দোষারোপের ভয়ানক ও ব্যাপক অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। বিশেষত করোনা রোগী এবং ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা এর টার্গেট হচ্ছেন। এ কারণে তাদের বাড়িতে হামলা এবং বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার মতো অঘটনও ঘটেছে।
গবেষকদ্বয় বলেছেন, এ মুহূর্তেই এই আতঙ্ক ও অপবাদকে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রশাসনের সহায়তায় একটি টিম গঠন করতে হবে। এতে থাকবেন রাজনীতিক, সমাজসেবী, ধর্মীয় নেতা আর জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা। তদুপরি, গণমাধ্যমে যথার্থ তথ্য দিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গুজবের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের বিকল্প নেই বলে তারা মনে করেন। করোনা বিপর্যয় শুধু দৈহিক বিপদ নয়, আর্থিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিকসহ নানাবিধ সঙ্কট ও জটিলতারও জন্ম দিয়েছে। তাই এই পরিস্থিতিতে রোগের চিকিৎসা এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপের সাথে আতঙ্ক ও অপবাদের অবসানসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও গ্রহণ করা জরুরি।
আমাদের প্রত্যাশা, উল্লিখিত গবেষণার আলোকে বাস্তবতা অনুধাবন করে অবিলম্বে কার্যকর ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষ দ্বিধা করবে না।