সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৩৭ অপরাহ্ন

দেশে ফেরার অপেক্ষায় কর্মহীন বিপুল লেবানন প্রবাসী

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৭ মে, ২০২০
  • ২১৪ বার

লেবাননের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রায় দেড় লাখ কর্মী রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজারই নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। গত বছরের শেষের দিকে দেশটিতে ডলারের বাজারে অস্থিরতা শুরু হলে সঙ্কটে পড়েন প্রবাসীরা। স্থানীয় মুদ্রা লিরায় বেতন পান প্রবাসীরা। কিন্তু ডলারে মূল্য দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী বা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় মাস শেষে খরচ বাদে দেশে টাকা পাঠানোর অবস্থা নেই তাদের। এই সঙ্কটের মধ্যেই নতুন করে শুরু হওয়া মহামারী করোনার থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রবাসীদের জীবন। এমনতিতেই নানা কারণে সঙ্কটে ছিলেন বিপুল অবৈধ বাংলাদেশী। এর মধ্যে করোনার কারণে অনেক কোম্পানির কাজ বন্ধ হয়ে পড়ায় চাকরিহারা হন বিপুল বৈধ প্রবাসীও। কাজকর্মহীন বিপুল প্রবাসী গাদাগাদি করে একই রুমে ৮-১০ জন করে থাকছেন। রয়েছে খাবার সঙ্কট। ফলে বৈধ অবৈধ বিপুল বাংলাদেশী দেশে ফিরতে চান।

জানা যায়, নানা সঙ্কটে গত সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করে লেবানন সরকার। দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ডলারের দাম। কমতে থাকে দেশটির স্থানীয় মুদ্রার (লিরা) ক্রয়ক্ষমতা। আগে যেখানে এক ডলার কিনতে লাগত ১৫ শ’ লিরা, এখন তা কিনতে লাগছে ৪ হাজার ২ শ’ লিরা। এমতাবস্থায় দেশে ফিরতে দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন লেবানন প্রবাসীরা। দূতাবাস এ ব্যাপারে নোটিশ দিলে প্রায় ৭ হাজার ৬৭৪ জন বাংলাদেশী দেশে ফেরার জন্য রেজিস্ট্রশন করেন। কিন্তু এরই মধ্যে করোনা সঙ্কট দেখা দেয়ায় বন্ধ হয়ে যায় বিমান যোগাযোগ। ফলে এসব বাংলাদেশীর দেশের ফেরার পথ আটকে যায়।

২০১৪ সালে কর্মের সন্ধানে লেবাননে যান বি-বাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শরীফ আহমেদ রানা। সেখানে যাওয়ার ২ বছর পর থেকেই অবৈধ হয়ে পড়েন তিনি। এরপরও লেবাননের রাজধানী বৈরুত ও এর আশপাশে কাজ করতে ছিলেন তিনি। বর্তমানে বৈরুত শহরে বসবাসকারী শরীফ আহমেদ রানা নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, এমনিতেই ডলার সঙ্কটে রয়েছি দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে করোনার কারণে গত ৬-৭ মাস ধরে কাজ নেই। দেশে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা, বাড়ি থেকে (বাংলাদেশ) টাকা এনে চলতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ২-৩ মাস আগে দেশে ফেরার জন্য দূতাবাস নোটিশ দিয়েছিল আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশন করার জন্য। আমার মতো অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করেছেন। সবাই অপেক্ষায় আছি দেশে যাওয়ার। এখানে যারা আছে কি বৈধ-অবৈধ সবাই কষ্টে আছে। এই দেশে আর থেকে লাভ নেই। খুব খারাপ অবস্থা। বাড়ি থেকে টাকা এনে আর কত দিন চলব? আমরা দেশে যেতে চাই। সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদের দ্রুত দেশে নিয়ে যান। আমাদের বাঁচান।

প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে লেবাননে আছেন বি-বাড়িয়ার আরেক যুবক মোহাম্মদ সুহেল। তিনিও অবৈধ হয়ে পড়েছেন বছর আড়াই হলো। তিনি বলেন, ডলার সঙ্কটের কারণে বিগত প্রায় ৮ মাস হলো দেশে টাকা পাঠাতে পারি না। এরই মধ্যে গত ৪ মাস ধরে কাজ নাই। আমরা যারা আছি তাদের ১০ ভাগও এ দেশে ভালো নেই। আমরা দেশে যেতে চাই। সুহেল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা স্থানীয় মুদ্রা লিরায় বেতন পাই। কিন্তু সেটা যখন ডলার করতে যাই তখন আর কিছুই থাকে না। শুধু শরীফ আহমেদ রানা কিংবা সুহেল নন। লেবাননে হাজার হাজার প্রবাসী এখন একই সঙ্কটে রয়েছেন। তারা এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ দিন ধরে বেকার অবস্থায় থাকায় দেশে ফিরতে টিকিট কাটার টাকাও নেই অনেক প্রবাসীর। অবৈধ তো বটেই বৈধ প্রবাসীরা এখন লেবাননে থাকতে চান না। এই শ্রমবাজার নিয়ে আর কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না তারা। তাই অবৈধদের পাশাপাশি বৈধ বাংলাদেশীরাও দেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। বৈরুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে যেমন প্রবাসীদের দেশে ফিরতে চাপ রয়েছে বাংলাদেশের ওপর, লেবাননে এটি নেই। দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল মামুন নয়া দিগন্তকে জানান, এত দিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাতে পারতেন না। কাজ হারাচ্ছিলেন। কোভিড-১৯ আসার ফলে প্রবাসীরা আরো বেশি কাজ হারাচ্ছেন। বিপুল প্রবাসী ৭-৮ মাস ধরে কর্মহীন। এখন আর কাজ পাওয়ার আর তাদের (প্রবাসী) আশা নাই। সব কিছু মিলিয়ে তারা আর এ দেশে থাকতে পারছেন না। দেশে ফিরতে চান। কিন্তু দেশে যেতে পারছেন না, কারণ করোনার কারণে সব ফ্লাইট এখন বন্ধ।

তিনি বলেন, আমাদের (দূতাবাস) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে বাস্তব অবস্থা জানিয়েছি। পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মস্থান মন্ত্রণালয় ঢাকায় আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএম ঢাকা অফিসের সাথে কথা বলেছে। ঢাকা অফিসের সাথে যোগাযোগ করে লেবাননের আইওএম কর্মকর্তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আমরা তাদের সাথে মিটিং করেছি। আমরা বিস্তারিত আলোচনায় প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছি। আইওএম চেষ্টা করছে তাদের খরচে কিছু লোককে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার। এজন্য তারা ফান্ড খুঁজছে। তারা ডোনার পেলে কিছুসংখ্যক প্রবাসীকে দেশে পাঠানো যাবে বিনা খরচে।

আব্দুল্লাহ আল মামুন আরো জানান, দেশে ফিরতে আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত ৭ হাজার ৬৭৪ জন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এরপর লকডাউনের কারণে আর নতুন করে আবেদন নেয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, খাবার সমস্যা সবার নেই। আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। আমরা এখনো কর্মহীনদের খাবার দিচ্ছি। সহায়তা আরো হয়তো লাগবে। এ ছাড়া আইওএম কিছু সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে লেবাননে শ্রম উইংয়ের এই প্রথম সচিব বলেন, লেবাননে ডিটেনশন সেন্টারে ৮৫ জন আটক আছে। অসুস্থ রোগী আছেন কয়েকজন। যখন ফ্লাইট চালু হবে, এরা প্রথম ফ্লাইটে যাবেন। এরপর দেশে ফেরার জন্য যারা আবেদন করেছিলেন, ট্রাভেল পারমিট যাদের পাওয়া গেছে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এরপর বাকিদের দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

অন্যান্য দেশের মতো লেবানন সরকার বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠাতে চাপ দিচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে চাপ ছিল না। তবে ইদানীং চাপ দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার আমরা এখানকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে মিটিং করেছি। আগামীকাল সোমবার লেবার মিনিস্ট্রির সাথে মিটিং আছে আবার। তারাও এখন চাচ্ছে যাদের কাজ নেই তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে। তবে লেবানন সরকার এ ব্যাপারে কোনো আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে না। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com