বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন

প্রয়োজন না হলেও ভারতের সাথে যৌথ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ

আশরাফুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৪৮ বার

বাংলাদেশ-ভারতের সমান মালিকানায় গড়ে উঠেছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি নির্মাণ থেকে শুরু করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ সব কিছুই করা হচ্ছে সমহারে। কিন্তু কেন্দ্রটি পরিচালনায় লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু করে সার্বিক তত্ত্বাবধান সব কিছুতেই রয়েছে ভারতের আধিপত্য। শুধু তাই নয় নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে কেন্দ্রের উৎপাদন ঘন ঘন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আর এ ত্রুটি মেরামতে যে বিদেশী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেটিও ভারতের মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানটির নাম জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিমেন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড। অথচ কারিগরি ত্রুটির কারণে ঘন ঘন বন্ধ থাকলেও ঠিকই কেন্দ্রভাড়া দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ত্রুটি সারাতেও দফায় দফায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যার অর্ধেক বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। শুরুতেই এই কেন্দ্র নিয়ে আশঙ্কা করা হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তা আমলে নেয়নি। এটি যখন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখনো এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল না। আর এখন চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। ফলে এখন এই কেন্দ্র একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। উপরন্তু নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে কেন্দ্রের উৎপাদন ঘন ঘন বন্ধ থাকলেও কেন্দ্রভাড়া দিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে দিতে হচ্ছে ঋণের কিস্তি। এক কথায় বলা যায়, কেন্দ্রটি বাংলাদেশকে অনেক ভোগাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুরু থেকেই মিথ্যাচার ও লুকোচুরির অভিযোগ রয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল কেন্দ্রটি নির্মাণে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। বেশ পরে জানা গেল, আসলে সেখানে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রযুক্তির চেয়ে প্রথম প্রযুক্তি ব্যবহারে কয়লার দূষণ হয় কম। দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য সহজে পাওয়া গেলেও রামপাল কেন্দ্রের সঠিক তথ্য কখনোই পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশ জটিল। সেখান থেকেও সহজে তথ্য পাওয়া বেশ মুশকিল। নানা কসরতে সাধারণ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে কেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। পরে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বে গঠিত হয় নতুন কোম্পানি। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল ক্রয় চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ক্রয় চুক্তির সময় কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৮৫ টাকা ধরা হলেও বর্তমানে কয়লার মূল্যবৃদ্ধির কারণে দাম দিতে হবে ১৪ থেকে ১৫ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষে কিছু শর্ত পূরণ হওয়ার পর বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ বা সিওডি (কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট) ঘোষণা করা হয়। এরপর ওইদিন থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনায় সাধারণত এমন নিয়ম অনুসরণ করা হলেও ব্যতিক্রম হয় কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে। কেন্দ্রটি নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রটিকে ‘ব্যাক ডেটে’ বা আগের তারিখে বিল পরিশোধ করার অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। এরপর মন্ত্রণালয়, পিডিবি এবং পিজিসিবির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কারিগরি কমিটি ওই কেন্দ্র পরিদর্শন করে। শর্ত অনুযায়ী, একটানা ৭২ ঘণ্টা থেকে সাত দিন পর্যন্ত পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। পাশাপাশি অন্যান্য শর্ত পূরণের পর কমিটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ ঘোষণার সুপারিশ করে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের আগে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করা হয় না। অভিযোগ উঠেছে, ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া নেয়ার আশায় শর্ত পূরণ না করেই তড়িঘড়ি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা হয়। ফলে বিদ্যুৎ যতটুকুই উৎপাদন হোক তার বিল তো পাবেই, পাশাপাশি উৎপাদন না করলেও কেন্দ্রভাড়া দিতে হয় এ কেন্দ্রকে।

এ দিকে চালু হওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই কারিগরি ত্রুটির কারণে মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের ২৯ মার্চ কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে মেরামত শেষে প্রায় পাঁচ দিন পর কেন্দ্রটি আবার চালু করা হয়। এর আগেও কয়েক দফা কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায় কারিগরি সমস্যার কারণে। এ পর্যন্ত ১০ বারেরও বেশি কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। আর বরাবরই বলা হয় কারিগরি ত্রুটির কারণে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একবার বন্ধের পর চালু করতে দুই তিন দিন সময় লাগে। প্রতিবার চালু করতে বেশি পরিমাণে জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এতে খরচ বাড়ে। তাই এসব বড় কেন্দ্র সার্বক্ষণিক চালু রাখা প্রয়োজন। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘন ঘন কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়ার কারণে এর যন্ত্রপাতির মান যাচাই করা জরুরি। কারিগরি সমস্যার মধ্যে আছে, টার্বাইনে ত্রুটি, বয়লার টিউব লিকেজ বা ফেটে যাওয়া, কুলিং হিটারে ছিদ্র দেখা দেয়া, হাই প্রেশার স্টিম লিকেজ, অয়েল লিকেজ, গ্ল্যান্ডফিল লিকেজ ইত্যাদি। তারা বলেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি চালাতে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, রামপালে সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে কি না, ওই প্রযুক্তিকে সাপোর্ট দেয়ার মতো যন্ত্রগুলো যথেষ্ট মানসম্মত ও আধুনিক কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তারা জানান, বয়লার টিউব ফেটে গিয়েছে। আবার এসব টিউব মেরামতে ভারতীয় কোম্পানিকে দিয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানেও উচ্চ ব্যয়ে পরামর্শক আনা হচ্ছে। আবার সমহারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মালিক হলেও কেন্দ্রটির উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ভারতীয়দের আধিপত্য বেশি। এ কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।

 

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com