ইসরাইল লেবাননে শনিবার বোমা বর্ষণের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। তারা ১২ বার বিমান আক্রমণ চালিয়েছে বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলের শহরতলিতে । তা ছাড়া হিজবুল্লাহ এবং গাজার হামাস উভয়কে লক্ষ্যবস্তু করে এই প্রথম ইসরাইল উত্তরের আরো গভীরে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে আঘাত হেনেছে।
ওই অঞ্চলে সংঘাত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাসহ লেবাননের হাজার হাজার হাজার মানুষ ক্রমাগত পালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গাজায় যুদ্ধ শুরু হ্ওয়ার বার্ষিকীর প্রাক্কালেই বিশ্বজুড়েই সমাবেশ হয়েছে।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলছে, লেবাননের উত্তরাঞ্চলের ত্রিপোলির কাছে বেদাউই শিবিরে ইসরাইলের আক্রমণে হামাসের সামরিক শাখার এক কর্মকর্তা, তার স্ত্রী ও দুটি ছোট মেয়ে নিহত হয়েছে। এএফপি ওই কর্মকর্তাকে সাঈদ আতাল্লাহ আলী বলে সনাক্ত করেছে। পরে হামাস জানায়, লেবাননের বেকা উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে সামরিক শাখার আরেকজন সদস্য নিহত হয়েছে।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলছে, লেবাননে হামাসের সামরিক শাখার দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তারা হত্যা করেছে। সেখানে সাম্প্রতিক সপ্তাহে লড়াই তীব্রতর হয়েছে। ইসরাইলে-হামাস যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ইসরাইল লেবানন-ভিত্তিক হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হ বহু হামাস কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।
ইসরাইল বলছে, তারা অভিন্ন সীমান্ত থেকে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে হিজবুল্লাহ কমান্ডার ও তাদের সামরিক সাজসরঞ্জামকে লক্ষ্য বস্তু করছে।
দু সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে অসামরিক লোকজন, প্যারামেডিকস ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাসহ কমপক্ষে ১,৪০০ লেবাননবাসীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ লাখ মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
লেবাননের সব চেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের অব্যবহিত পরে ইসরাইলে রকেট হামলা শুরু করে। তারা বলে, এটি হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সমর্থন। হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন গুলি বিনিময় হয়েছে।
গত সপ্তাহের এক নাগাড়ে ইসরাইলি আক্রমণে দীর্ঘ দিনের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ও অন্যরা নিহত হবার পর ইসরাইল তাদের কথায় সীমিতভাবে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে স্থল অভিযান চালায়। প্রচণ্ড স্থল সংঘাতে নয়জন ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছে। ইসরাইল বলছে, ওই একই সংঘাতে ২৫০ জন হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী শনিবার জানায়, লেবানন থেকে প্রায় ৯০টি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলি অঞ্চলে নিক্ষেপ করা হয়। অধিকাংশটিকে মাঝ পথেই থামিয়ে দেয়া হয়। তবে অনেকগুলো আবার উত্তরাঞ্চলের আরব শহর দেইর আল আসাদে গিয়ে পড়ে, যেখানে পুলিশ বলছে তিনজন আহত হয়।
এদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি দামেস্কে সংবাদদাতাদের বলেছেন, ‘আমরা গাজা ও লেবাননে অস্ত্র বিরতিতে পৌঁছাবার চেষ্টা করছি।’ মন্ত্রী অবশ্য ওইসব দেশের নাম উল্লেখ করেননি, যারা এই উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে কেবল এটুকু বলেছেন যে এই উদ্যোগে রয়েছে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের কিছু দেশ।
আরাঘচির এই বক্তব্যের এক দিন আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসরাইলে তাদের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের প্রশংসা করে বলেন যে প্রয়োজন হলে তারা আবার এ রকমটি করতে প্রস্তুত রয়েছে।
পায়ে হেঁটে লেবানন থেকে পালাচ্ছে লোকজন
লেবাননের রাষ্ট্র-পরিচালিত সংবাদ মাধ্যম ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সির মতে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার অবধি ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে।
লেবাননের সরকারি কমিটির মতে দু’সপ্তাহেরও কম সময়ে ইসরাইলি আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রায় ৩,৭৫,০০০ লোক সীমান্ত পেরিয়ে লেবানন থেকে সিরিয়ায় চলে গেছে।
এসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকরা দেখেছেন বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি বিমান আক্রমণে রাস্তায় বড় বড় গর্ত হওয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার লোক পায়ে হেঁটে মাসনা সীমান্ত অতিক্রম করেছে। মনে করা হয় যে ইরানের কাছ থেকে হিজবুল্লাহর অধিকাংশ অস্ত্রই আসে সিরিয়া হয়ে।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের বিশেষ বাহিনী হিজবুল্লাহ অবকাঠামোর বিরুদ্ধে স্থল আক্রমণ চালাচ্ছে যার ফলে ক্ষেপণাস্ত্র, নিক্ষেপের স্থান, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এবং অস্ত্র গুদামের মতো স্থাপনাগুলি ধ্বংস হয়েছে।
আরো মানুষকে গাজা ত্যাগের আদেশ
ফিলিস্তিনের চিকিত্সা কর্মকর্তারা বলেছেন, গাজার উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে শনিবার ইসরাইলি আক্রমণে অন্তত নয়জন লোক প্রাণ হারিয়েছেন।
উত্তরাঞ্চলের বেঈত হানুন শহরে একটি আক্রমণে দুই শিশুসহ অন্তত পাঁচজন প্রাণ হারায় বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় । আওদা হাসপাতাল বলছে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানলে কমপক্ষে চারজন প্রাণ হারান।
ইসরালি সামরিক বাহিনী এ ব্যাপারে তাত্ক্ষণিক কোনো মন্তব্য দেয়নি্ কিন্তু হামাসকে অসামরিক এলাকা থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযুক্ত করে আসছে।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গাজার মধ্যাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ নেতজারিম করিডর ধরে সেই স্থান ত্যাগ করতে ফিলিস্তিনিদের সতর্ক করে দিয়েছে। এলাকাটি অস্ত্র বিরতি চুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নুসেইরাত ও বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের অংশ বিশেষ ত্যাগ করে লোকজনকে মুওয়াসি নামের উপকুলীয় অঞ্চলে চলে যেতে সামরিক বাহিনী নির্দেশ দিয়েছে। এই এলাকাটিকে ইসরায়েল মানবিক অঞ্চল বলে অভিহিত করছে।
এটা এখনো পরিষ্কার নয় ঠিক কতজন ফিলিস্তিনিকে ওই অঞ্চল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে যে গত এই প্রায় এক বছরের যুদ্ধে প্রায় ৪২,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তারা অবশ্য নিহত সামরিক ও বেসামরিক লোকদের সংখ্যা আলাদা করে জানায়নি। তবে এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে গাজার বাসিন্দাদের প্রায় ৯০ ভাগই এখন বাস্তুচ্যূত।
সূত্র : ভিওএ