সার্ভিক্স ও ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং প্রকল্পের ২৭০ কোটি টাকার অনিয়ম করে প্রকল্প পরিচালক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। প্রকল্পে কর্মরতদের পারিশ্রমিক বুঝিয়ে না দিয়েই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আজ সোমবার বিদেশ চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছেন, আজ যেকোনো সময় তিনি ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে। ‘ইলেকট্রনিক ড্যাটা ট্রেকিং এবং জনসংখ্যা ভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান সংক্রান্ত ২৭০ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়ার কারণে চলতি বছরের গত জুনেই তা সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্পের পুরোপুরি অডিট এখনো হয়নি, প্রকল্প সরকারকে বুঝিয়েও দেয়া হয়নি। এমতাবস্থায় প্রকল্পের পিডি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি অনকোলজিস্টের অধ্যাপক ডা: আশরাফুন্নেসা যুক্তরাজ্যে চলে যেতে চাচ্ছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রকল্পে কর্মরত ৬৯ জন চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, যে হারে এতদিন তাদের বেতন দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালক তা থেকে ১০ গুণ খরচ বেশি দেখিয়েছেন। সম্প্রতি কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে প্রকল্পে কর্মরতরা এ সংক্রান্ত অনেকগুলো ভাউচার পেয়েছেন যেখানে তাদেরকে পরিশোধ করা বেতন-ভাতার চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, কোনো কাজ করলে পরিচালক সব সময় টাকার পরিমাণ না বসিয়েই তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নিয়েছেন। পরে এসব ভাউচার প্রত্যক্ষ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেখানোর প্রমাণ পেয়েছেন। এসব ভাউচারের কপি নয়া দিগন্তের হাতে রয়েছে।
এসব ভাউচার প্রত্যক্ষ করে এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, সেসব ভাউচার অনুযায়ীই তারা প্রকল্প থেকে সম্মিলিতভাবে সাত কোটি টাকার বেশি পাবেন যা প্রকল্প থেকে পিডি অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা তাদের নামে তুলে নিয়েছেন কিন্তু তাদের পরিশোধ করেননি। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলছেন, এতদিন তারা নি¤œ পেমেন্টে এই প্রকল্পে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন কারণ এই প্রকল্পটিকে এক সময় ইনস্টিটিউট করা হবে বলে প্রকল্পের সরকারি কাগজ-পত্রেই লেখা ছিল। এই উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ-ব্লকের ৩টি ফ্লোর বরাদ্দ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ‘এক সময় তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভিক্স অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক ইনস্টিটিউটে আত্তীকৃত হবেন’ এই স্বপ্নে কম পে-মেন্টেই কাজ করেছেন। এখন এই প্রকল্পটিকে বন্ধ করে দেয়া হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রকল্পটিকে ‘ওউন’ করছে না বলে স্বপ্ন ভঙ্গের এই যাতনায় তারা মর্মাহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক মো: সায়েদুর রহমানের সাথে দেখা করে তাদের আত্তীকৃত করার দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি। অপরদিকে প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার সাথেও তারা কয়েকদিন আগে দেখা করেছেন।
অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার সাথে দেখা করে তারা তাদের পাওনা এবং অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ভাউচার অনুযায়ী তারা সাত কোটি টাকা পাবেন তা জানালে সার্ভিক্স অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার-বিষয়ক স্ক্রিনিং প্রকল্পের শুরুটা ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়। এতদিন বিভিন্ন নামে প্রকল্পটি পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালে ইলেকট্রনিক ড্যাটা ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হয়। আগের প্রকল্পের জনবল দিয়েই প্রকল্পের কাজ চললেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ‘স্কিল্ড ম্যানপাওয়ার লিমিটেড’ নামক আউট সোর্সিং জনবল হিসেবে দেখানো হয়। এই আউট সোর্সিং কোম্পানির মালিক আবার অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার মেয়ের জামাই। এই কোম্পানির ঠিকানা রাজধানীর ধানমন্ডির ৮/এ (নতুন) রোডের ৮১ নম্বর গ্রিন তাজ সেন্টারের পঞ্চম তলায়। স্কিল্ড ম্যানপাওয়ার লিমিটেড নামক আউট সোর্সিং কোম্পানির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, এটা অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার প্রাইভেট চেম্বারেই। প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘আশরাফুন্নেসা ম্যাডামের মেয়ের জামাইয়ের নামে হলেও এই আউট সোর্সিং কোম্পানির জনবলের সব কাজটি তিনি নিজেই করতেন। আউটসোর্সিংয়ের নামে বেতন কম দেখিয়ে প্রকৃত বেতন অনেক বেশি দেখিয়ে তিনি নিজে তুলে নিয়েছেন।’
‘বেতন কম দিয়ে ভাউচারে আপনি বেশি তুলে নিচ্ছেন কেন’ এ প্রশ্ন করলে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে বেতন কম দেখানোর কথাটি স্বীকার করেছেন। তিনি তাদের বলেন, ‘এটা করেছি, কারণ বিভিন্ন জায়গায় বাড়তি টাকা দিতে হয়। এই টাকাতো আর আমার পকেট থেকে দিতে পারব না, সে কারণেও এটা করেছি।’ বলে অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা স্বীকারোক্তি দেন তাদের কাছে। এর একটি ভিডিও ক্লিপ রয়েছে নয়া দিগন্তের কাছে। এভাবে অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা সরকারি টাকার নয়ছয় করে নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন।