‘আমাকে বাসা থেকে নিতে গলির মাথায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাম্বুলেন্স। আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম, তাই দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বসি। এক টানে অ্যাম্বুলেন্সটি ছুটে গেল মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে।
‘অ্যাম্বুলেন্স চালক একটি লাইন দেখিয়ে দিয়ে বললো, সেখানে গিয়ে বলতে আমি করোনা পজেটিভ। এরপর তারাই ভর্তির ব্যবস্থা করবেন। সেখানে গেলাম, ভর্তিও হলাম। কিন্তু কোনো নার্স বা চিকিৎসক আমার কাছে এলো না। কয়েক হাত দূরে থেকেই নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। এতটাই দূরে থেকে তারা কথা বলছিল যে, জোরে জোরে চিৎকার করে করে আমার নাম বলতে হয়েছে। না হলে তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না।
‘সব শুনে তারা খাতায় এন্ট্রি করে আমাকে বলল ৭ তলার ৭০৬ নাম্বারে চলে যান। আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে গেলাম সেই রুমে। গিয়ে দেখি একটি বেডে একজন মানুষ শুয়ে আছেন। আমি ভাবলাম তিনিও হয়তোবা করোনা রোগী। তাকে দুইবার ডাক দিলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। হয়তোবা তিনি ঘুমাচ্ছেন এটা মনে করে তার পাশের বেডে আমি জিনিসপত্র রেখে শুয়ে রইলাম।
‘একটু পরে এক যুবক কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে বলল, দাদার লাশটা আরও কতক্ষণ পড়ে থাকবে। আল্লাহ তুমি কই,আল্লাহ। এইবার ওই যুবক কিছু বলার আগেই আমি বুঝে ফেললাম রোগী ভেবে আমার পাশের বেডে যিনি শুয়ে আছেন তিনি আসলে একটা মৃত লাশ। আতঙ্কে উঠে বেডের ওপরে বসে পড়লাম আমি। বুকের ভেতর ভয়ে ধক ধক করে কাঁপছে। শুরু হলো আমর জীবন-মৃত্যুর সাথে বসবাস। মনটাও কিছুটা ভেঙে গেল।
‘এরপর ওই রুমে আমার চোখের সামনেই আরও লাশ হয়েছেন ৪ করোনা রোগী। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছি আমি।’
এভাবেই দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনের কাছে নিজের করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ১৯ দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন খলিলুর রহমান। তিনি পেশায় একজন গণমাধ্যমকর্মী।
রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে গত ২৪ এপিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। পরে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু ভুলতে পারছেন না সেই হাসপাতালে তিক্ত অভিজ্ঞতা।
খলিলুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে প্রথমে একটি ধাক্কা খেয়েছি। যে রুমে লাশ রয়েছে সেই রুমেই আমাকে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলে পারতো ওই লাশটি রুমের বাইরে রাখতে। পরে শুনলাম লাশটি ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে ছিল কেউ দেখতেও আসেনি। এরপর তারাই লাশটি কোলে করে নিয়ে যায়।’
মৃত্যুর ৪ বর্ণনা
খলিলুর রহমান জানান, তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রুমের সবগুলো বেডেই রোগী চলে আসে। কোনো বেডেই ফাঁকা ছিল না। আর তার রুমেই মারা যান আরও চারজন। তারা তার আশেপাশের বেডেই ছিলেন।
প্রথম মৃত্যু
‘আমার বেড নম্বর ছিল ৩৬। আমার পাশের ৩৭ নম্বর বেডে একজন হিন্দু রোগী দেওয়া হয়েছে। তার স্বজনরা এসে রেখে গেছে আর খোঁজ নিতে আসেনি। তিনি সব সময়ই চিৎকার চেঁচামেচি করতেন, আহাজারি করতেন। শ্বাস নিতে পারতেন না। কোনো ডাক্তারও দেখতে আসতেন না। পরে আমরাই গিয়ে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসি। কিন্তু কীভাবে তা লাগাতে হয় আমরা যারা,রোগী ছিলাম কেউই জানতাম না।
২৫ তারিখ সকাল ৮টার দিকে তিনি ঘুম থেকে উঠে একাই ব্রাশ করে এসে ঘুমিয়ে ছিলেন। সেই যে ঘুমালেন, আর জেগে উঠলেন না। আমরা অন্য রোগীরা দূর থেকে দেখি তিনি কোনো নড়াচড়া করছেন না। ওভাবেই মারা গেছেন তিনি।
লাশের পাশে বসেই আমরা ৬ জন রোগী ছিলাম সেই রুমে সবাই খাওয়া-দাওয়া করেছি। কি করবো ওষুধ তো খেতে হবে। এই ৬ জনের মধ্যে আমরা তিনজন ছিলাম যুবক। আর বাকি তিনজন বৃদ্ধ। তারা এমন মৃত্যু ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
সেই দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত লাশটি আমাদের রুমেই ছিল। ২টার দিকে ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের একজন সহকারী পরিচালক ভিজিটে আসেন। তাকে আমরা বিষয়টি জানালে তিনি লাশটি রুম থেকে বের করে নেওয়ার ব্যবস্থা নেন’ বলে জানান খলিল।
দ্বিতীয় মৃত্যু
খলিল বলেন, ‘চতুর্থ দিন আরেকজন বৃদ্ধলোক ছিলেন। যিনি এতটাই অসুস্থ যে কথাও বলতে পারেন না। তারও কোনো স্বজন হাসপাতালে খোঁজখবর নিতে আসে না। ওই দিন রাত ২টার দিকে দেখি সেই বৃদ্ধ লোকটি বেডে থেকে নিচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে আছে। পরে আমরা অন্য রোগীরা গিয়ে দেখি তিনি মরে পড়ে আছেন। তখন নার্সকে ডাকি, ডাক্তার কে ডাকি কেউই রুমে আসে না।
তখন আমরা তার ঝোলানো মাথাটা বেডের ওপরে তুলে ঢেকে রাখি। যাতে অন্য বৃদ্ধ রোগীরা দেখে ভয় না পান। কারণ এমন অবস্থায় কোনো লাশ দেখলে যে কেউ স্ট্রোকও করতে পারে। পরে বেডটাই আমরা ঠেলে ঠেলে রুম থেকে বের করে বাইরে রাখি। এরপর একজন ওয়ার্ড বয়কে অনুরোধ করি লাশটা সেখান থেকেও সরাতে।’
তৃতীয় মৃত্যু
তৃতীয় ব্যক্তির মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে খলিল বলেন, ‘৫ম দিনে আরেকজন বৃদ্ধ লোক ছিলেন তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তার সঙ্গে অবশ্য স্বজন ছিল। ওই রোগীর ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। ওনার ছেলেরা তাকে পপুলারে নিয়েছিল। পরে সেখানে থেকে তাকে মুগদা এনে ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি আগেও একবার স্ট্রোক করেছিলেন বলে জানিয়েছে তার ছেলেরা। সেই রাতেই তিনি মারা গেলেন।’
চতুর্থ মৃত্যু
‘ষষ্ঠ দিন একজন রোগী মারা গেল। মারা যাওয়ার আগে তার প্রচুর ডায়েরিয়া হয়েছিল। তার সাথেও ছেলেরা ছিল। তাকে স্যালাইন খাওয়াতো। কিন্তু তিনি অনেক মোটা ছিলেন, তাই তাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে অনেক কষ্ট হতো।
পরে ওই রাতে তিনিও মারা গেছেন। পরে তার লাশ নিয়ে যায় সন্তানরা’ বর্ণনা দেন খলিল।
‘করোনা রোগী হয়েও গিয়েছি দোকানে’
হাসপাতালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে খলিল বলেন, ‘খাওয়ার জিনিস এবং ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়ে আমি নিজেই হাসপাতালের বাইরে গিয়েছিলাম। কি করবো, আসলে কিছুই করার ছিল না। বাঁচতে হলে প্রয়োজনীয় খাবার তো কিনতেই হতো।’
তিনি বলেন, ‘বাইরে যাওয়ার সময় আমি মুখে ডাবল মাস্ক এবং পিপিই পড়েছিলাম। যাতে আমার মাধ্যমে অন্য কেউ আক্রান্ত না হয়। দোকানে জিনিসপত্র কেনার সময় সাবধানে ছিলাম যাতে কেউ কাছে না আসে। আবার বুঝতেও দেইনি আমি করোনা রোগী। কারণ এ কথা জানলে কেউ দোকান থেকে কিছু বিক্রি করবে না আমার কাছে।’
হাসপাতাল থেকে বাইরে গেলেও কেউ বাধা দেয়নি কিনা-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনা রোগী শুনলেই আনছার-স্টাফরা পালায়, বাধা দেবে কে! অবশ্য তারাও জানেন, দরকারি জিনিসপত্র কিনতেই অনেকে বাইরে যায়।’
‘আতঙ্কে বেশ,পড়তাম কোরআন’
অন্য সকল দিনগুলো তার কাছে আতঙ্কের ছিল জানিয়ে খলিল বলেন, ‘আমি সেখানে যত দিন ছিলাম সব সময়ই একটা ভয়, আতঙ্ক কাজ করেছে মনে। কারণ হাসপাতালের এসব দৃশ্য দেখে ঘুম হতো না,ঠিকমতো। তবে যদি কখনো বেশি খারাপ লাগত নামাজ পড়তাম, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতাম।’
সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে খলিল বলেন, ‘সবাই সাবধানে থাকবেন। আমার মতো কাউকে যেন এমন মৃত্যুর মুখে পড়তে না হয়। আমি ফিরতে পারলেও অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন।’