স্বদেশে কাক্সিক্ষত কাজ না পেয়ে আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ অভিবাসী হচ্ছেন। তারা মূলত মানবপাচারকারীদের দেশীয় চক্রের খপ্পরে পড়ে এই বিপদসঙ্কুল পথে পা বাড়ান। পাচারকারী চক্রের প্রলোভনের জালে আটকে উন্নত জীবনের আশায় দু®ৃ‹তকারীদের হাতে অসহায় এসব বনি আদম নিজেদের স্বেচ্ছায় সঁপে দিচ্ছেন। তারা ঘুণাক্ষরেও টের পান না কী ভয়ঙ্কর পরিণতি সামনে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এতে করে মর্মান্তিক ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেককে। এসব ঘটনায় অকাতরে জীবন যাচ্ছে বহু অভিবাসনপ্রত্যাশীর। ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ছোট ছোট নৌকায় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরপথে অথৈ জলরাশিতে কত বাংলাদেশী তরুণের সলিল সমাধি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের অজানা। এটি জীবনের নির্মম অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহতে গত বৃহস্পতিবার মানবপাচারকারী চক্রের যৌথ গুলিবর্ষণে ৩০ অভিভাসনপ্রত্যাশীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশী। এ ঘটনায় আরো ১১ বাংলাদেশী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা বেদনাবিধুর। লিবিয়া ট্র্যাজেডি ফের সবার সামনে মানবপাচারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরল। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি পাঁচ বছর ধরে বন্ধ থাকলেও অবৈধ পথে যাওয়া থেমে নেই। মানবপাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে স্বল্পখরচে ইউরোপে যাওয়ার লোভে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা নিষিদ্ধ পথে পা বাড়াচ্ছেন। ফলে তারা যেমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন, তেমনি মাঝে মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের শিকারও হচ্ছেন। যেকোনো হত্যা দেখলেই মন ব্যথায় ডুবে যায়। আর লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন অভিবাসীর হত্যাযজ্ঞ রীতিমতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। ৩০টি তরতাজা প্রাণের অপমৃত্যু কতটা উদ্বেগের তা বলে বোঝানোর নয়। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য মতে, মানবপাচারকারী চক্রের প্রতিশোধস্পৃহা জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে। এতে করে দেশে মানবপাচারকারীরা এখনো কতটা সক্রিয়, তা ফের প্রমাণিত হলো।
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো ‘প্রবাসী আয়’ বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত গড়তে কয়েক দশক ধরেই বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তাই আমাদের দেশের বাইরে শ্রমবাজার খুঁজতে হবে, সেটি অনস্বীকার্য। দেশে নতুন কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না; এসব কিছু বিবেচনায় নিলেও লিবিয়ার মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যাওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ, বিষয়টি সবাইকে ভাবতে হবে। কারণ, দেশটির ক্ষমতা কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে চলছে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে করে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, সেখানে কারো কোনো নিরাপত্তা নেই।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলেও অবৈধ অভিবাসন কারো কাম্য হতে পারে না। মানবপাচারকারীদের হাতে দেশের তরুণদের এমন মৃত্যু ঘটুক তা কেউ নিশ্চয়ই চান না। অবশ্যই জীবিকার চেয়ে জীবনের নিরাপত্তা অগ্রাধিকারযোগ্য। যারা জীবিকার জন্য চরম ঝুঁকি নিচ্ছেন, তাদের অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। কারো প্ররোচনায় নয়, বরং নিজের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করতে হবেÑ যেখানে নিরাপত্তা নেই, যে পথে বৈধতা নেই, রাষ্ট্রের কোনো সাহায্য পাওয়ার আশাও নেই; সে পথে পা বাড়ানো মানে বোকামি। আর বোকামির মাশুল দিতে হয় কড়ায়গণ্ডায়। বিদেশে শ্রমিক হিসেবে নয়, দক্ষ জনশক্তি হিসেবে যাওয়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। তাতে কাক্সিক্ষত অর্থ উপার্জন করা সহজ। একই সাথে দেশের ভাবমর্যাদা বিদেশের মাটিতে উজ্জ্বলও হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সবিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
আমরা বলতে চাই, সরকারকে কেবল এ ঘটনায় দোষীদের বিচার চাইলেই হবে না; কূটনৈতিক মাধ্যমে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবেÑ এই মর্মান্তিক ঘটনার যথাযথ বিচার যেন মেলে। কিন্তু আমাদের দেশের কূটনীতিকদের পেশাদারি মনোভাবের অভাব অনেক ঘটনায় পরিলক্ষিত হয়। সেজন্য লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে সক্রিয় রাখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নজরদারি বাড়াতে হবে।