আর্থিকভাবে শক্তিশালী এবং ব্যক্তি, সরকার ও বেসরকারি খাতের অর্থের উৎস ব্যাংক খাত। উদ্যোক্তা হিসেবে উচ্চ মুনাফা এবং কর্মকর্তা হিসেবে মোটা অঙ্কের বেতনের নিয়তান্ত্রিকভাবে পরিচালিত নিশ্চিত ক্ষেত্র দেশের ব্যাংকগুলো। অথচ করোনার তিন মাসের আঘাতেই তছনছ হয়ে পড়েছে শক্তিশালী এ খাত। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় আমানত কমে যাচ্ছে। প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে তা সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না। ফলে আয় কমে মুনাফা ব্যাপকহারে কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। টিকে থাকতে এখন কর্মকর্তাদের বেতন কমানো শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তিনটি ব্যাংক বেতন কমিয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যা ংকগুলো কমাবে বলে জানা গেছে।
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু ৮ মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টানা সাধারণ ছুটি ছিল। এখন সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করা হলেও উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। টানা ছুটিতে কাজ হারিয়ে বেকারত্ব বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় গরিব মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ, বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ বিভিন্ন দেশের লকডাউনের কারণে। এ অচলাবস্থার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। কারণ মানুষের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমানত রাখার পরিমাণ কমে আগের আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে তীব্র সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত।
দেশে কার্যরত ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯টি। আরও ৩টি ব্যাংক বাজারে আসার অপেক্ষায়। কিন্তু করোনার সংক্রমণ ব্যাংক খাতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। এপ্রিল শেষে আমানত প্রায় ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কমে গেছে। জানুয়ারিতে মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এরপর তিন মাসে উত্তোলনের পর দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। এপ্রিলে যে ঋণ বিতরণ হয়েছে তা স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আমানত কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদ বলেন, বাস্তব কারণে আমানত কমে গেছে। এ সময়ে আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মানুষের চলাচল সীমিত থাকার প্রভাবও আমানতের ওপর পড়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চেষ্টা করছে এ সময়ে কীভাবে তারল্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যায়। তাই মুনাফা করার জন্য নয়, দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক খাতের সংকট অন্য খাতের মতো এখনো তীব্র হয়নি।
তবে সংকট আসন্ন। এই জন্য ব্যাংকের মালিকরা কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ শতাংশ কমানো, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতি বন্ধসহ ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে। এদিকে এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বেতন কমানোর আগে খরচ কমানোর অন্য সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের আগের বছরের মতো উচ্চ মুনাফার প্রত্যাশা পরিহার করা উচিত। এগুলো করার পর বেতন কমানো উচিত ছিল। তবে এর মধ্যে সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক বেতন কমিয়ে দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলো কমানোর জন্য কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
বিএবি চেয়ারম্যান এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, করোনার কারণে আমানত কমে যাচ্ছে। ঋণের টাকা আদায় হচ্ছে না। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে সেটিও নিশ্চিত নয়। এই মুহূর্তে কোনো ব্যাংকারের চাকরি চলে যাক এটি ঠিক হবে না। তাই খরচ কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের শক্তিশালী অবস্থা ফিরে এলে সবকিছু স্বাভাবিক করা যাবে।
করোনার সংকট যেমন ব্যাংকগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে, অন্যদিকে সরকার ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে সরকার ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর বেশিরভাগ অর্থ ঋণ হিসেবে দেবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আগামী বছরে দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। এজন্য নতুন বিনিয়োগ করতে হবে ৫ লাখ কোটি টাকা। বিনিয়োগের অর্থায়নের উৎস দেশের ব্যাংকগুলো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো প্রবল চাপে রয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট যেভাবে করা হয়েছে সেজন্য চাপ আরও বাড়বে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট রয়েছে। এ সংকটের মধ্যে ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে পারবে কিনা সেটিই শঙ্কার বিষয়।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির জানান, এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। তবে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকের অবস্থা ভয়াবহ নড়বড়ে। টিকে থাকার জন্য বিদ্যমান খরচ কমানো হচ্ছে। ব্যাংকের সম্প্রসারণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন নতুন ঋণ দেওয়া দূরের কথা, পুরনো ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা বেশি।
নতুন প্রজন্মের এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভয়াবহ খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছি। ব্যাংকারদের মধ্যে ব্যাপকহারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এমন শাখা আছে যেখানে ৫০-৬০ ভাগ কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়ে গেছেন। এখন শাখা কীভাবে সচল রাখা যাবে সেটিই চিন্তার বিষয়। আমানত সংগ্রহ, ঋণ আদায় ইত্যাদি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের আয় কমে গেছে।
এদিকে করোনার পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেউ ঋণের টাকা ফেরত না দিলে তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া এপ্রিল ও মে মাসের সুদ কিছুটা স্থগিত এবং কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন আমাদের সময়কে বলেন, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করায় আগের তুলনায় কমে গেছে। এখন ক্রেটিড কার্ড, ভোক্তা ঋণ ও এসএমইসহ অন্যান্য ঋণের আদায় কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে ১০০ টাকা আয় করতে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ব্যয় হতো। এখন এই ব্যয় ৬৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ক্রমশ এই ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা অনেক খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে কোনো ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগে খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা থাকলেও এবার এমন কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আরও ৫৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ছাড় দিয়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর আগে খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা গেলে করোনা সংকট অনেক সহজেই মোকাবিলা করা যেত। কিন্তু বাজেটে ছাড়ের উদ্যোগ ইতিবাচকভাবে উল্লেখ করা হলেও কঠোরতার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।