করোনা ভাইরাসের থাবায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। এ খাতের রপ্তানি ঠেকেছে তলানিতে; একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রমিকদের ওপর। অধিকাংশ কারখানায়ই হিড়িক পড়েছে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের। বিশেষ করে সামনে কোরবানির ঈদ থাকায় বেতনের পাশাপাশি বোনাসের বাড়তি চাপ পড়বে কারখানা মালিকদের ঘাড়ে। এ কারণেই যেসব কারখানায় কাজ নেই, সেগুলো আগেভাগেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি যেসব কারখানায় স্বল্প পরিসরে কাজ চলছে, তারা প্রয়োজনীয় শ্রমিক রেখে বাকিদের ছাঁটাই করছে। এভাবে ছাঁটাইয়ের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে দানা বাঁধছে অসন্তোষ। আসন্ন ঈদের আগেই এ অসন্তোষ মারাত্মক রূপ নিতে পারে, অনেকেই এমন আশঙ্কা করছেন।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, কারখানায় কাজ না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে; মালিকরা বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন।
এদিকে শ্রমিকদের এভাবে ছাঁটাই না করে কম বেতন দিয়ে হলেও ধরে রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও পোশাক খাতের শ্রমিকনেতারা। তারা বলছেন, দেশের স্বার্থে ও বেকারত্বের বোঝা কমানোর জন্য সরকার ও মালিকপক্ষ মিলে অর্ধেক বেতন দিয়ে হলেও শ্রমিকদের ধরে রাখতে হবে। তা না হলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। এর ফলে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। বৈষম্য বাড়বে। সর্বোপরি অপরাধ বৃদ্ধিরও আশঙ্কা
রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে দেশের পোশাক খাতের প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২৯টি কারখানায় প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে।
শিল্প পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৮৬টি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে ১৬ হাজার ৮৫৩ জন, নিটওয়্যার শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১৬টি কারখানায় ছাঁটাই হয়েছে ২ হাজার ২৯৮ জন। বস্ত্র খাতের সংগঠন বিটিএমএর সদস্যভুক্ত ৪টি কারখানায় ছাঁটাই হয়েছে ২৫৮ শ্রমিক। এ ছাড়া বেপজা অন্তর্ভুক্ত ৮টি কারখানায় ছাঁটাই হয়েছে ৫৬ শ্রমিক। অন্যান্য ১৫টি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে ১ হাজার ৮৬৬ জন। সবচেয়ে বেশি ছাঁটাই হয়েছে আশুলিয়া অঞ্চলের পোশাক কারখানায়। এ অঞ্চলে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ জন।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পোশাক কারখানায় নানা কৌশলে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। শ্রমিকদের সাময়িক ছুটি দিয়ে এখন আর কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া যাদের কাজের বয়স এক বছর হয়নি এবং যাদের বয়স এর একটু বেশি হয়েছে, তাদেরও ছাঁটাই করা হচ্ছে। করোনার এ সময় দেশের চার হাজারের বেশি কারখানার মধ্যে ৭০ শতাংশ কারখানায়ই প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাকশিল্পে আয় কমেছে ১৯ শতাংশ।
বিজিএমইএ বলছে, বিশ্ববাজারে ৩১৮ কোটি ডলারের বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছে ক্রেতারা। ফলে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা এবং ৩৫ বিলিয়নের মতো রপ্তানি আয় নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে এবং শ্রমিক ছাঁটাই হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটিই স্পষ্ট। কারণ দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। কারখানা বন্ধ হলে রপ্তানি কমে যাবে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে। যে করেই হোক শ্রমিক ছাঁটাই না করে কম বেতন দিয়ে হলেও জীবন বাঁচানোর জন্য ধরে রাখা দরকার।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের পরামর্শক ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ফলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একদিকে বেকারত্ব বাড়বে, দারিদ্র্যের হার বাড়বে, অন্যদিকে সামাজিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। সমাজের অপরাধও বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রথম শর্তই হচ্ছে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা। কিন্তু পোশাক খাতে স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি কাজ করে। এ রকম হয়ে গেলে দারিদ্র্য বেড়ে যাবে। ফলে তারা দারিদ্রসীমা নিচে চলে যাবে। এসডিজির লক্ষ্য অর্জন হবে না। তা ছাড়া এই কর্মহীন মানুষদের খুব সহজেই অন্যত্র কর্মসংস্থান করা যাবে না। তাই যে করেই হোক সরকারের পক্ষ থেকে বেতনের কিছু অংশ ও মালিকদের পক্ষ থেকে কিছু অংশ দিয়ে হলেও তাদের চাকরিতে বহাল রাখা উচিত। তিনি বলেন, বাজেটে রপ্তানি বাড়াতে যে অর্থের জোগান রাখা হয়েছে সেটি কেবল কারখানা চালু রাখা ও শ্রমিকদের বেতন দেওয়া বাবদ দেওয়া উচিত। কারণ এখন রপ্তানি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানিকারকদের এ সুযোগটি শর্ত দিয়ে দেওয়া উচিত যারা কারখানা চালু রাখবেন এবং শ্রমিক ছাঁটাই করবেন না তারাই কেবল এ সুযোগ পাবে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখ্ত আমাদের সময়কে বলেন, সরকার ও মালিকপক্ষ মিলে সমাধান করা দরকার। মালিকদের পক্ষ থেকে অর্ধেক অর্থের জোগান দিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া উচিত। যাতে তারা ন্যূনতম জীবন বাঁচাতে পারে। তা না হলে সমাজে অপরাধ বেড়ে যাবে।
এদিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ আমাদের সময়কে বলেন, কাজ থাকলে কারখানা চলবে, কাজ না থাকলে কারখানা বন্ধ হবে এটিই স্বাভাবিক। এটি মালিকদের বিষয়। তারা কারখানার চালাতে না পারলে জোর করার কোনো সুযোগ নেই।
এটিই বাস্তবতা কেবল বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বের পরিস্থিতি ভয়াবহ। কারখানাগুলোতে কাজ নেই, অর্ডার নেই। সব মালিকই চান কারখানা চালু রাখতে। কিন্তু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করছেন।
এদিকে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্বে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়া খুবই দুঃখজনক। সরকার কারখানা মালিকদের প্রণোদনা দিচ্ছে, বাজেটে তাদের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার পরও তারা কেন এ অসহায় শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে তা আমার বুঝে আসছে না। তিনি আরও বলেন, সরকার বিভিন্ন সময় পোশাকশিল্প মালিকদের সহায়তা দিয়ে আসছে। কোনো সমস্যা থাকলে সরকারকে বলতে পারে, সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু তা না করে একদিকে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নিচ্ছে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে, অন্যদিকে কারখানা বন্ধের নামে শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এটি খুবই দুঃখজনক।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রমিকরা কই যাবে? খুব সহজেই তো তারা কোথাও চাকরিতে ঢুকতে পারবে না। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করব একটি সুনির্দিষ্ট আইন করা উচিত। শ্রমিক কীভাবে বেঁচে থাকবে। কারখানা বন্ধ করলেও যাতে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত কোনো শ্রমিক তার ক্ষতিপূরণ পাননি। মালিকরা বিভিন্ন ধরনের ছলচাতুরি করে চাকরিচ্যুতি, ছাঁটাই করেন। কিন্তু তাদের আইন অনুযায়ী কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেন না। এ ব্যাপারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে তাতে ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।