করোনার সংক্রমণে তিন মাসের অচলাবস্থায় স্থবির হয়ে পড়ে অর্থনৈতিক কর্মকা-। এ সময় জীবন বাঁচাতে ঘোষিত ছুটির মধ্যে জীবিকা নির্বাহ নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েন বিভিন্ন কর্মজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- এখনো স্থবির। তবে কিছু খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সামনে আরও বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কাও থাকছে। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে কয়েকটি খাতের অগ্রগতি। এর মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স, রিজার্ভ ও রপ্তানি বৃদ্ধি। এ অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে মন্দা অবস্থার কবল থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে করোনার সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ৮ মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ছিল। লকডাউনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আমদানি-রপ্তানি ও স্থানীয় বাণিজ্যও থমকে দাঁড়ায়। ৩১ মে থেকে সাধারণ ছুটি বাতিল হলেও অচলাবস্থা কাটেনি। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে আসতে পারেনি সব কিছু। উন্নয়ন কর্মকা-, দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি সব কিছু পতনের ধারায় রয়েছে। কাজ হারিয়ে মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। টিকে থাকার জন্য শহরের বাসিন্দা গ্রামে ফিরছেন।
অনেকেই পেশা বদল করে কোনো রকম জীবিকা চালানোর চেষ্টা করছেন। করোনা বিশ^ অর্থনীতিকে ভয়াবহ মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব থেকে বাদ পড়ছে না বাংলাদেশও। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, করোনার প্রভাবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসতে পারে। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও গত বছরের তুলনায় অর্ধেকের কম হবে। ইতোমধ্যে কাজ হারিয়ে বেকার মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এটি তিনগুণ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ থেকে জীবন রক্ষা করা গেলেও খাদ্যের অভাবে জীবননাশ বাড়ার আশঙ্কা করছে বিভিন্ন সংস্থা।
করোনার ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা আলো রেখা দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে ইতিবাচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বৃদ্ধি। তিন বছর পর করোনা সংকটের মধ্যে রিজার্ভ ৩০০ কোটি ডলার (৩ বিলিয়ন) বেড়েছে। রিজার্ভ ২০১৭ সালের জুনের ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। সেটি তিন বছর ওই অবস্থায় ওঠানামা করেছে। গত জুনের প্রথম দিকে তা ৩৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে এবং জুনের শেষদিনে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছে। এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রিজার্ভ বেশি থাকায় তা দিয়ে এই সংকটের মধ্যে উন্নয়নকাজে খরচের চিন্তা করছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ঘোষণা দিয়েছেন।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম উদ্দীপক প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশেষ করে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সরবারহ বৃদ্ধি করা। করোনার কারণে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে রেমিট্যান্স ভয়াবহভাবে কমে যায়। কিন্তু জুনে আগের সব রেকর্ড ভাঙে। জুনে একক মাসে সর্বোচ্চ ১৮৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুনে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরেও রেকর্ড ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। এটি একক অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে।
সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর ক্ষুদ্র ব্যবসা সচল হতে শুরু করেছে। সাধারণ ছুটির পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য যে খাদে পড়েছিল সেখান থেকে উত্তরণ হতে শুরু করেছে জুনেই। পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে এবং কিছু কিছু পণ্য বিক্রি আগের তুলনায় বাড়তে শুরু করেছে। মোটরসাইকেল, মোবাইল, গৃহস্থালী সামগ্রী ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, ফ্রিজ, রড-সিমেন্ট ইত্যাদি বেচাকেনা বাড়ছে। তবে করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, বিমান চলাচল, পর্যটন, বিলাসী দ্রব্য, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, শপিংমল কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এদিকে করোনার সময় সবচেয়ে বেশি সচল কৃষি খাত। ফসল উৎপাদন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থার কৃষক ন্যায্যমূল্য পায়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অর্থনীতিতে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও অভ্যন্তরীণ বাজার ও চাহিদা ইতিবাচক আশা দেখাচ্ছে। এগুলোকে ব্যবহার করে আসন্ন মন্দা মোকাবিলা করতে হবে। সরকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে। মানুষের আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল করা যাবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো না গেলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি শ্রম রপ্তানি বন্ধ। অনেককে ফেরত আসতে হচ্ছে। এতে রেমিট্যান্স কমে যাবে। রিজার্ভ বেশি আছে ইতিবাচক। তবে আমদানি বাড়লেও রিজার্ভের চাপ বেড়ে যাবে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দা হতে যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। আগামীর অর্থনীতিকে রক্ষা করতে বৈশি^ক মন্দা, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। অভ্যন্তরীণ যে ইতিবাচক দিক রয়েছে সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে অর্থনীতিক সচল রাখতে হবে।
করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মধ্যে পড়ে দেশের রপ্তানি খাত। নতুন করে রপ্তানি আদেশ আসা দূরের কথা আগের আদেশ বাতিল হতে থাকে। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামে। কিন্তু জুনে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। যদিও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় জুনে আবার রপ্তানি আড়াই শতাংশ কমে গেছে। গত অর্থবছরে রপ্তানি ১৭ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। নতুন করে রপ্তানি আদেশ আসা শুরু হয়েছে। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি কমে গিয়েছে। মে মাসে আমদানি (এফওবি) ৩১ শতাংশ। জুলাই-মে মাসে আমদানি ৪ হাজার ৬২৪ কোটি ডলারের, আগের বছরর তুলনায় ১১ শতাংশ।
চামড়া খাতের সংগঠন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, আগামী মৌসুমের জন্য কিছু কিছু ক্রয়াদেশ মিলছে। তবে উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরেকটি দিক হলো, চীনের পাশাপাশি অন্য উৎস থেকে বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য কেনার যে প্রবণতা তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তার সুফল কিছুটা বাংলাদেশ পেতে পারে। তা অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি নয়।
এদিকে করোনার সংকটের সময় ডিজিটাল ব্যবসা বা ই-কমার্স সচল ছিল উল্লেখ্যযোগ্য হারে। মানুষের নিত্যপণ্যের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে চালডাল ডটকম, আজকের বাজার, অথবা ডটকম, স্বপ্নসহ বেশি কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। যদিও সামগ্রিকভাবে ই-কমার্সের ব্যবসায়ও মন্দার প্রভাব পড়েছে। তবে সংকটের মধ্যে আগামীতে ই-কমার্স ব্যবসাকে প্রসারিত করতে হবে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেন, করোনার কারণে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মাসিক ক্ষতি ৬৬৬ কোটি টাকার মতো। তবে করোনার সময় নিত্যপণ্যে সেবা দিয়ে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের ১৫ শতাংশ বেশ ভালো করছেন। বাকি ৮৫ শতাংশ বেকায়দায় পড়েছেন।
আশার আলোর বিপরীতে অবস্থান বেশির ভাগ সূচকের। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থমকে দাঁড়ানোয় সরকারের রাজস্ব আদায় তলানিতে নেমেছে। মে মাসেই রাজস্ব আদায় কমেছে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। জুলাই-মে মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা, আগের বছরের তুলনায় কমেছে ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকার ব্যাপক হারে ব্যাপক হারে ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। গত অর্থবছরের আগের ব্যাংগুলোর ঋণ দ্বিগুণের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর ফলে বেসরকারি খাত ঋণ পায়নি।
বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেসরকারি বাধাগ্রস্ত হয়ে হয়ে কর্মসংস্থান ও মানুষের আয় কমে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। বিমান চলাচল উন্মুক্ত হওয়া শুরু হলেও বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের বিমান স্থগিত করছে। রেমিট্যান্স বাড়লেও বিপদ বাড়ছে শ্রম রপ্তানির। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শ্রম রপ্তানি বন্ধ। আগের যাওয়া শ্রমিক ফেরত পাঠাচ্ছে কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইতালি, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ।