তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চাইছে বিএনপির হাইকমান্ড। ফলে অঙ্গসংগঠনগুলোর কাঠামোতেও নতুনত্ব আসবে। আগের মতো অঞ্চলভিত্তিক নেতার পকেট কমিটি গঠনের সুযোগ থাকবে না। কেননা বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্র ও তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠন নিয়ে বরাবরই নেতাকর্মীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। কমিটিতে যোগ্য ব্যক্তিকে মূল্যায়ন না করা, আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ না থাকলেও বড় পদে দেয়া, পছন্দের অনুসারী দিয়ে কমিটি গঠন করার অভিযোগ লেগেই থাকে। অনেক সময় দায়িত্বশীল নেতারা নিজেদের আস্থাভাজন লোক দিয়ে কমিটি গঠন করে থাকেন বলে পদবঞ্চিতরা অভিযোগ তুলেন। এমতাবস্থায় পদবঞ্চিত ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি ভোট কিংবা কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা। তা না হলে প্রকৃতপক্ষে ত্যাগী, যোগ্য, পরিশ্রমী নেতারা মূল্যায়িত হন না। অবশেষে দীর্ঘদিন পর সেই পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে বিএনপি।
সংগঠনের সবপর্যায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। একইসাথে কমিটিতে নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী রাখার ওপরও জোর দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিভিন্ন স্তরের নেতারা। এতে করে যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা মূল্যায়িত হবেন বলে তারা প্রত্যাশা করেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশের নতুন ও শিক্ষিত প্রজন্ম পরিবর্তন চায়। তাদের প্রত্যাশা পূরণে আমাদেরকে সে পথেই রাজনীতি করতে হবে। নতুন প্রজন্ম কিন্তু আপডেট। তাদের চাওয়াগুলোকেও প্রাধান্য দিতে হবে। না হলে এগোনো যাবে না। রাজনৈতিক নীতি বা উদ্দেশ্যটা তাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। শুধু বড় বড় বক্তব্য দিয়ে রেটোরিক (ছন্দময়) কথা বললে হবে না। এখন সবাই পরিবর্তন চায়। ইতোমধ্যে দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বিএনপির রাজনীতিতেও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক কাঠামোতে আরো পরিবর্তন আনতে হবে। সবার সহযোগিতায় বিএনপিতে আরো বড় পরিবর্তন আসবে বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাউন্সিলে ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো। দীর্ঘদিন পর সেই ধারার সূচনা করে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। সংগঠনটির আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর তাদেরকে দেয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নির্বাচিত কমিটির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করে অধ্যাপক ডা: ফরহাদ হালিম ডোনারের নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি। এরপরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ২৯ বছর পর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠনের নির্দেশনা দেন। এতদিন ধরে সংগঠনের সাবেক নেতাদের দ্বারা গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই ছাত্রদলের কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছিল। সবধরনের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ভোটে ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। এখন তারাও সারা দেশে তৃণমূলপর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ফলে মহানগর, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়নেও ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। কয়েকটি কমিটি ভোটের মাধ্যমে গঠনও করা হয়েছে।
জানা গেছে, কাউন্সিলের মাধ্যমে ড্যাব ও ছাত্রদলের কমিটি গঠন সফল হওয়ায় অন্যান্য সংগঠনেরও ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, গত শনিবার রাতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ড্যাব এবং ছাত্রদলের নেতৃত্ব ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসায় যেমন সমাদৃত হয়েছে তেমনই নিজ সংগঠনের ভেতরেও সম্মান ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে। কোনো চাপ ছাড়াই তারা নির্ভার হয়ে কাজ করছে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখছে। একই প্রক্রিয়ায় তিনি বিএনপির সর্বস্তরের কমিটি গঠনেরও নির্দেশনা দেন।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী কমিটিতে ৩০ শতাংশ নারী রাখার বিষয়টিতেও জোর দেয়া হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। দলের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন নেতাকর্মীরাও। তা ছাড়া যেসব অঙ্গসংগঠনের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ কিন্তু কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি সেসব আর পূর্ণাঙ্গ করা হবে না এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করে সম্মেলনের দ্বারা নতুন কমিটি হতে পারে। সংগঠনের পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীরা এখন কাউন্সিলের দ্বারা নতুন নেতৃত্ব চান বলে জানা যায়। অন্যান্য সংগঠনেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে দলটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভোটের মাধ্যমে কমিটি হলে দলের ভেতরে নতুন রাজনীতির শুভ সূচনা হবে। ফলে পরিশ্রমী ও ত্যাগী নেতারা মূল্যায়িত হবেন। কারণ কাউন্সিল না হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে দলের হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে নেতাকর্মীদের জন্য সুফল আসবে।