শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৭ অপরাহ্ন

গরু আর চামড়া বিক্রি না হলে মরবে গরিব শিশুরা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০
  • ২৯৭ বার

আমেনা বাওয়ার বাড়ি চৌহালি উপজেলার স্থল আর সদিয়া চাঁদপুরের মাঝামাঝি এক গ্রামে। স্বামী তাঁতের কাজ করত এনায়েতপুরে। বছরছয়েক আগে কোনো এক ভাদ্র মাসে কারবারিদের নৌকায় ফিরতি পথে স্বামী কাসেম আর ফিরতে পারেনি। ভরা যমুনায় হঠাৎ বাতাসে তাদের নৌকা উল্টে গেলে যে তিনজনের কোনো হদিস মেলেনি তাদের একজন ছিল এই বাকপ্রতিবন্ধী কাসেম। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমেনার সেই একা এগিয়ে যাওয়া, বেঁচে থাকা। ২০১৫ সালে তিনি সমিতির মাধ্যমে স্থানীয় এক ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দুটো বাছুর কেনেন। দশ মাসের মাথায় কোরবানি ঈদের বাজারে তিনি দুই গরুর যে দাম পান তাতে তার লাভ হয় ৪৫ হাজার টাকা। ঋণের টাকা শোধ করার পর সেটা তার হাতে থাকে। অবশ্য দশ মাসে বাড়ির সবার পরিশ্রম, ঘাস-পাতা, খুদ-কুঁড়া, কাইশ্যা-বিচালি, খ্যাসারি, ভাতের মাড় ইত্যাদির হিসাব ধরলে প্রকৃত আয় আরও কম। গত বছরের ঈদের হাটে তার ছয়টা গরু উঠেছিল, সবার আগে বিক্রিও হয়েছিল সেসব গরু। মেয়ে মরিয়মের পোষা দুটো যমুনাপারি জাতের খাসিও বেচতে পেরেছিল ভালো দামে। পাইকাররা বাড়ির ওপর থেকে নিয়ে গিয়েছিল। এবার বন্যা-ভাঙন-ভাইরাসে জেরবার। পাইকারদের উল্টা খবর পাঠিয়েও কোনো রাও-শব্দ মেলেনি।

বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশে প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ কোরবানিযোগ্য প্রাণী ছিল। এর মধ্যে গরু ৪৫ লাখ এবং ছাগল ও ভেড়া ৭১ লাখ। গত কয়েক দশকে ছোট-বড় অনেক খামার তৈরি হলেও এখন সিংহভাগ কোরবানির প্রাণী আসে গৃহস্থের কাছ থেকে। ঈদের বাজার সামনে রেখে বাড়িতে একটা বা দুটি গবাদি প্রাণী পালন করে ভূমিহীন প্রান্তিক পরিবার। বিক্রির টাকায় কী করবে না করবে সেটাও তার পরিকল্পনায় থাকে। ঘর মেরামত থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, বিয়ের খরচ, কৃষিতে নতুন বিনিয়োগ এবং পরের ঈদের জন্য গবাদি প্রাণী সংগ্রহ প্রভৃতি নানা কাজে বিক্রির টাকাটা তারা খরচ করেন। খরচ করেন ঋণ পরিশোধের জন্য। সব খরচ খাতের মধ্যে শেষেরটাকে তারা সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। ঋণ পরিশোধ করে তারা আরেকটা ঋণ গ্রহণ করেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আগের ঋণের চেয়ে পরের ঋণের আকার বড় হয়। এভাবে যিনি প্রথম বছরে একটা গরু বা তিনটা ছাগল নিয়ে শুরু করেছিলেন তিন বছরের মাথায় তিনি চারটা গরু বা গোটা দশেক ছাগলের একটা বাড়িভিত্তিক খামার করে ফেলেছেন। যেটা তার পরিপূরক আয় ছিল। কালক্রমে সেটা পরিবারের প্রধান আয়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রবিধি প্রায় সবটায় নির্ভর করে তৈরি প্রাণীর উপযুক্ত বাজার মূল্যের ওপর।

চামড়াশিল্পও নির্ভর করে ঈদে গবাদি প্রাণীর কেনাবেচার ওপর

সরকার ধারণা করেছিল ২০২১ সালের মধ্যে চামড়া খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয়ের দরজা খুলে যাবে। তাই অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৭ সালে চামড়াশিল্পকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকেই হিসাব উল্টো পথে ঘুরতে থাকে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ মার্কিন ডলার। পরের অর্থবছর (২০১৬-১৭) রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর পরের বছর (২০১৭-১৮) এই খাত থেকে রপ্তানি আয় ১২ শতাংশ কমে যায়, আসে ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এর পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ কমে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ১০১ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে।

কেন এমন হলো

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ শাহিনের ধারণা, ২০১৭ সাল থেকে চামড়াশিল্পে সংকট বিরাজ করছে। ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে সেন্ট্রাল ইটিপি নির্মিত হয়নি। ফলে বিদেশি ক্রেতা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে অনীহা দেখাচ্ছে। তাই ট্যানারি মালিকদের কেউ আর আড়তদারের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনছে না।

পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারে স্থানান্তর, বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস এবং সর্বশেষ মহামারী করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) ধাক্কায় মজুদ পড়ে আছে তিন হাজার কোটিরও বেশি টাকার কাঁচা চামড়া। এর মধ্যে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য ফিনিশড লেদারও রয়েছে, যা করোনা ভাইরাসের কারণে রপ্তানি করতে পারেনি ট্যানারিগুলো। এতে করে ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। নতুন ক্রয়াদেশ আর আসছে না। এমন সংকটে থাকা চামড়াশিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো আসন্ন কোরবানির ঈদে প্রাণীর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণে ঈদের আগে ব্যাংক ঋণের নিশ্চয়তাসহ প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা চান ব্যবসায়ীরা।

ঈদুল আজহা এ দেশে প্রাণীর চামড়া সংগ্রহের মূল সময়। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এসব চামড়ার ৬০ শতাংশেরও বেশি সংগ্রহ করা হয় কেবল কোরবানির গবাদি প্রাণী থেকে। কাজেই কোরবানির চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিকিকিনিকেন্দ্রিক যে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ এ সময় চলে একে সুশৃঙ্খল করা, সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনা খুবই জরুরি।

ব্যাংক ঋণ কি সমাধান সূত্র?

বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, করোনার কারণে এ বছর কোরবানি ৫০ শতাংশ কম হবে। তাই যদি হয় তা হলে চামড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ঘটবে কি? আড়তদাররা আগের দু-তিন বছরের বকেয়ার এক কানাকড়িও পায়নি, কোন ভরসায় তারা চামড়া কিনে লবণ মাখিয়ে রাখবে? শুধু চট্টগ্রামের আড়তদারদের বকেয়া পাওনা আছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। চামড়া কেনার সময় ট্যানারি মালিকরা মোট টাকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা পরে দেবেন বলে চামড়া নিয়ে যান। একই ঘটনা দেশের সব মোকামে। আড়তদারদের বকেয়া পড়ে আছে বছরের পর বছর।

উত্তরবঙ্গের বড় আড়ত নওগাঁয়। এই জেলায় চামড়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন। এ ছাড়া ১৫০ জনের মতো নানা ধরনের ছোট-বড় ফড়িয়া ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আছেন। এদের প্রায় সবাই এখন মূলধন হারিয়ে পথে বসার অবস্থা। ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকে থাকা টাকার তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। চামড়া ব্যবসায়ী সাদিক হোসেনের একারই প্রায় ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা আটকে আছে বছরের পর বছর। নওগাঁ অঞ্চলে কোরবানি মৌসুমে প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চামড়া কিনে নেন এসব চামড়া ব্যবসায়ী। এবার তাদের হাত খালি।

আড়তদারদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা দল পাকিয়ে চামড়া কেনায় চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। আবার দামে ঠকিয়ে চামড়া কিনলেও কেনে বাকিতে। কোনো প্রমাণ রাখে না, চেকের মাধ্যমে কোনো দাম চুকায় না। একটি কাগজে বকেয়া লিখে রাখে মাত্র। ফলে পরবর্তীকালে টাকা উদ্ধারের জন্য মামলাও করা যায় না।

অথচ ট্যানারি মালিকরা সরকার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য সহজ শর্তে কোটি কোটি টাকা ঋণ পেয়ে থাকেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক একটি দৈনিককে বলেন, গত বছর এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা পরিশোধের বিষয়ে কাজ করছি। ব্যাংক থেকে অর্থায়ন ও সরকারের সাড়া পেলে আশা করি দ্রুত এ বিষয়ে সমাধান হবে। করোনা পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাকশিল্প যদি প্রণোদনা পেতে পারে, চামড়াশিল্প কেন পাবে না। তাদের কথা, এ ক্ষেত্রে সরকার যে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেখানে আমরা ঋণ পাচ্ছি না। আমরা চাই প্যাকেজের আওতায় আমাদের যেন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। তা না হলে টিকে থাকা কঠিন হবে। একেই বলে ঝোপ বুঝে কোপ মারা।

শেষমেশ ক্ষতি কিন্তু গরিব আর এতিমদের

অনেক আশা নিয়ে পালা গরু-খাসি বিক্রি না হলে আমেনা বাওয়া ও মরিয়ম বিবিদের যেমন খাবার জুটবে না, তেমনি চামড়ার দাম না দিলে এ দেশের প্রায় ৭০ লাখ এতিম অভুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের প্রায় সব বেসরকারি এতিমখানা কোরবানির চামড়ার ওপর নির্ভর করে। অনেকেই তাদের জবাই করা প্রাণীর চামড়া বিনামূল্যে মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় দান করেন। সে চামড়া বিক্রির মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো অর্থ উপার্জন করে। গত বছর অনেক এতিমখানা চামড়া সংগ্রহ করতে আর তাতে লবণ মাখাতে যে টাকা খরচ করেছিল, সে টাকাটাও ওঠাতে পারেনি চামড়া বেচে। করোনা আসায় এতিমদের আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চামড়ার দাম না পেলে তাদের আর ফেরা হবে কি?

 

গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com