পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা বাড়ছে। তবে গত এক সপ্তাহের ঘটনায় তাদের সেই সম্পর্ক একেবারে যেন তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু নতুন এই মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বের পেছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে? এই উত্তেজনা-বৃদ্ধি কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে?
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়ার আদেশের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চেংডুর মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যেই চেংডু কনস্যুলেট ছাড়তে শুরু করেছেন আমেরিকান কূটনীতিকরা।
হিউস্টনের কনস্যুলেট থেকে চীন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ‘চুরি’ করার তৎপরতা চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ আনে মার্কিন প্রশাসন।
‘বিরল এবং নাটকীয়’ পদক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে একটি বিদেশী মিশন বন্ধ করে দেওয়া নজিরবিহীন কিছু নয়। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ সচরাচর ঘটে না এবং একবার ঘটে গেলে তা থেকে পিছিয়ে আসা কঠিন। মনে রাখতে হবে, চেংডুতে যা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তা একটি কনস্যুলেট, দূতাবাস নয়। তাই এখানে পররাষ্ট্র নীতিসংক্রান্ত কাজকর্ম হয় না।
কিন্তু বাণিজ্য এবং বৈদেশিক কর্মকাণ্ডের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর একটি ভূমিকা আছে। যেহেতু হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে চেংডুর মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে-তাই এতে যে কূটনৈতিক অবকাঠামোর মাধ্যমে দু’দেশের যোগাযোগগুলো হয়–তার একটা ক্ষতি তো হচ্ছেই।
এর আগে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা হিসেবে দু’দেশকে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ, কূটনৈতিক ভ্রমণের নতুন নিয়মকানুন, আর বিদেশী সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের মত পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। এবং সাধারণভাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রই বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে।
গুপ্তচরবৃত্তি সীমা ছাড়িয়ে গেছে
সব দেশেই বিদেশী মিশনগুলো থেকে কিছুটা গুপ্তচরবৃত্তি চালানো হয়ে থাকে- এটা মোটামুটি ধরেই নেওয়া হয়। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, হিউস্টনে যা হচ্ছিল তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিং
মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, হিউস্টন কনস্যুলেটটি অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিল এবং তাদের মতে সবগুলো চীনা কূটনৈতিক স্থাপনাতেই এটা চলছে। সে কারণেই এই কর্মকর্তারা বলছেন, তারা চীনকে একটা শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে এগুলো আর সহ্য করা হবে না।
এ মাসের প্রথম দিকে এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, যাতে তিনি বলেন, গত এক দশকে মার্কিন স্বার্থের প্রতি চীনা হুমকি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তাকে এখন গড়ে প্রতি ১০ ঘণ্টায় একটি নতুন কাউন্টার ইনটেলিজেন্স তদন্ত শুরু করতে হচ্ছে- যার সঙ্গে চীন সম্পর্কিত। তবে বেজিং সবসময়ই এসব অভিযোগকে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
তা ছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ড্যানি রাসেল মনে করেন, এটা হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক সমস্যা থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ারও একটা চেষ্টা হতে পারে।
তাহলে কি এর সঙ্গে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা সম্পর্ক আছে? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুটোই হতে পারে। ‘হ্যাঁ ’ উত্তরের পক্ষে বলা যায়, ট্রাম্প এখন তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে চীনবিরোধী কথাবার্তা পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করছেন। তার প্রচারকৌশলবিদরা মনে করেন এটা ভোটারদের মনে দাগ কাটবে।
ট্রাম্পের ২০১৬ সালের নির্বাচনী বিজয়ের আগেও চীনের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
বাণিজ্য, করোনাভাইরাস, আর হংকং-এই তিন ইস্যুতে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব বাড়ছে
এর সঙ্গে এবার যোগ করা হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা। এই সংকটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা করেছেন তাতে তার জনপ্রিয়তার গুরুতর ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু তার বার্তাটা হচ্ছে, কোভিড বিপর্যয়ের জন্য তিনি নন, বরং দায়ী হচ্ছে চীন।
আর ‘না’ উত্তরের পক্ষে যুক্তি হলো- ট্রাম্পের প্রশাসনের মধ্যে যারা কট্টরপন্থী–যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-তারা দীর্ঘদিন ধরেই বেজিং-এর বিরুদ্ধে কঠোর নীতি নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। এখন যে দৃষ্টিভঙ্গী নেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তি স্থাপন করেছেন এরাই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরং কট্টরপন্থীদের পরামর্শ এবং তার নিজের একটা বাণিজ্য চুক্তি ও চীনা নেতা শি জিনপিং-এর সঙ্গে তার ‘বন্ধুত্ব’ বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটা দোদুল্যমান অবস্থায় ছিলেন। তবে এখন কনস্যুলেট বন্ধ করার ঘটনায় আভাস মিলছে যে মার্কিন প্রশাসনের ভেতরে ‘হক’ বা কট্টরপন্থীরা এখন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ।
করোনাভাইরাস পৃথিবীতে যে দুর্যোগ নিয়ে এসেছে-তার ব্যাপারে চীনা সরকারের স্বচ্ছতার অভাব ওয়াশিংটনে ক্রোধ সৃষ্টি করেছে। আর এই ক্রোধ মার্কিন প্রশাসনের কট্টরপন্থীদের জন্য সহায়ক হয়েছে।
চীন-মার্কিন সম্পর্ক এখন কতটা খারাপ হয়েছে?
সম্প্রতি চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, মার্কিন কর্মকর্তারা সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে যাওয়ার দায় চাপিয়েছেন চীনের ওপর।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন অভিযোগ তুলেছেন যে ভাইরাসটি চীনের ল্যাবরেটরি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যদিও তার নিজের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই বলেছেন যে ভাইরাসটি ‘মানবসৃষ্ট বা জিনগতভাবে পরিবর্তিত’ নয়।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে এখনই দুদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এবং এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই দায়ী।
চীন আর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ থেকে এক ধরনের শুল্ক যুদ্ধেও লিপ্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই অন্যায্যভাবে বাণিজ্য পরিচালনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরির অভিযোগ তুলেছেন।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তার পূর্বসূরীদের চাইতে অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী পথ নিয়েছেন। হংকংয়ে চীনের জারি করা নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়ন করার পর যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলের বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা বাতিল করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও একটি আইন প্রয়োগ করেছেন, যেটি অনুযায়ী হংকংয়ে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে চীনের ঘরোয়া বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এর সমুচিত জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।
চীনের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের নিপীড়নও উত্তেজনা বৃদ্ধির একটি কারণ। এর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বেশি কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরু থেকেই সবক্ষেত্রে আমেরিকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার যে নীতি নিয়ে চলছেন তাতে এখন একটা আদর্শিক বিশ্ববীক্ষারও ছাপ পড়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ সপ্তাহেই দেওয়া এক বক্তৃতায় চীনা নেতাদের ‘বিশ্বব্যাপী প্রভুত্ব কায়েম করতে ইচ্ছুক স্বৈরাচারী’ বলে আখ্যায়িত করেন- যা স্নায়ুযুদ্ধের যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তিনি আমেরিকার সঙ্গে বেইজিং-এর এই প্রতিযোগিতাকে ‘স্বাধীনতা এবং দমননীতির চিরন্তন যুদ্ধ’ বলে চিত্রিত করেন।
অন্যদিকে বেইজিং-এর ধারণা হলো, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। হুয়াওয়ের মতো চীনা টেলিকম শিল্পকে ঠেকানোর প্রয়াসও তাদের বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। বিশেষ করে এখন তারা যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে – সেটাই আসলে বিশেষজ্ঞদের বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
অবশ্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি আমেরিকার প্রতি আবেদন জানিয়েছেন, যেন তারা এমন ক্ষেত্র বের করে যেখানে দু’পক্ষ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
এর পরিণতি কী হতে পারে?
বলা যেতে পারে, স্বল্পমেয়াদে যা হবে তা হলো মার্কিন নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিপজ্জনকভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধি। বিশ্লেষকরা মনে করে, চীনারা উত্তেজনা বৃদ্ধি হোক এটা চায় না এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও খুব গুরুতর সংঘাত চান না, সামরিক সংঘাত তো নয়ই।
ড্যানি রাসেল বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা না বাড়ানোর যে নীতি এতদিন চীন-মার্কিন সম্পর্ককে সংঘাত থেকে রক্ষা করছিল তা এখন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনে কে জিতবে তার ওপরই আসলে নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদে এ ক্ষেত্রে কী ঘটবে” তবে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন হয়তো সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী হবেন, কিন্তু প্রচারাভিযানে তিনিও চীনের ব্যাপারে কঠোর নীতি নেওয়ার কথা বলছেন। কারণে হোয়াইট হাউসে ঢোকার প্রতিযোগিতায় এটি একটি জনপ্রিয় ইস্যু।
রক্ষণশীল মার্কিন থিংক ট্যাংকের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জিম কারাফানো অবশ্য বলছেন, চীনকে চ্যালেঞ্জ করাটা আসলে উত্তেজনা বাড়াবে না বরং স্থিতিশীলত আনবে। তার কথা: ‘চীন কোথায় আমাদের স্বার্থের ক্ষতি করছে তা অতীতে আমরা পরিষ্কার করে বলিনি বলেই তাদের বাড় বেড়েছে।’
তবে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, উইলিয়াম কোহেন-যিনি ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় প্রতিরক্ষমন্ত্রী ছিলেন তিনি বলেন, চীনকে বৈরি হিসেবে দেখাটা বিপজ্জনক।
তার কথায়, ‘চীনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বলছে আমরা এতদিন যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছি এখন আর সেভাবে পারবো না। কিন্তু তার পরও তো আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।’