করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির কাণ্ড তদন্তকালে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং তার স্বামী ও প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। জেকেজি থেকে তারা করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট পাঠাতেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নামে খোলা ভুয়া ইমেইল থেকে।
প্রায় দুই হাজার ভুয়া রিপোর্ট পাঠানোর বিষয়ে অকাট্য প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। তবে এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। শুধু তাই নয়, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোনো অনুমোদনও নেই জেকেজি হেলথকেয়ারের। তদুপরি সেই লাইসেন্সও তারা নিয়েছেন করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পাওয়ার দুই মাস পর।
জালিয়াতির মামলার তদন্তকালে এসব বিষয় উঠে আসার পর গতকাল সাবরিনা-আরিফসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এতে সাবরিনা ও আরিফকে করোনা টেস্ট জালিয়াতির মূল হোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আসামিরা তাদের প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে সহযোগিতা করেছেন বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম মোস্তফা রাসেল আমাদের সময়কে বলেন, করোনা টেস্টের নামে জালিয়াতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আইইডিসিআরের নামে একটি ভুয়া ইমেইল খুলে তারা জাল সার্টিফিকেট পাঠাতেন। আমরা এক হাজার ৯৮৫টি ভুয়া রিপোর্টের বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি। তা ছাড়া ৩৪টি ভুয়া রিপোর্টও পেয়েছি।
আদালত সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার বেলা ২টার দিকে ঢাকা সিএমএম আদালতে আরিফ-সাবরিনাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। চার্জশিটে অপর অভিযুক্তরা হলেন- আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ূন কবির হিমু, তানজিলা পাটোয়ারী, বিপ্লব দাস, শফিকুল ইসলাম রোমিও ও জেবুন্নেসা।
মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে সংগ্রহ করা নমুনার কোনোটি জেকেজি ল্যাবে পাঠিয়েছে, আবার কোনোটির নমুনা পাঠায়নি। এমনও হয়েছে, পরীক্ষা করাতে আসা ব্যক্তিদের শুধু কাগজে লেখা কিছু করোনার উপসর্গ জিজ্ঞাসা করেও রিপোর্ট দিয়েছে। আইডিসি নামক ভুয়া ইমেইল সার্ভারের মাধ্যমে এসব মনগড়া রিপোর্ট তারা নমুনা জমা দেওয়া রোগীদের কাছে পাঠিয়েছে। জেকেজি কোনো তালিকাভুক্ত গ্রুপ অব কোম্পানি না। তাই সংশ্লিষ্টরা তাদের মন মতো পদবি ব্যবহার করেছেন। তাই ডা. সাবরিনা কখনো নিজেকে চেয়ারম্যান, কখনো কনভেইনার দাবি করতেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, এ মামলায় গত ২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হিরু স্বীকারোক্তি দিয়ে জানায়, সে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করত। যার সঙ্গে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত। ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। সিইও জানান, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর জ্ঞাতসারেই সব কিছু হয়েছে। এর পর গত ১২ জুলাই ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৩ জুলাই তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর পর ১৭ জুলাই তার ফের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আর মামলায় গত ২৩ জুন আরিফ চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে যান। পরবর্তী সময় গত ১৫ জুলাই তাকে ফের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে সব আসামিই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
ডা. সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তিনি আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়েছে। চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথকেয়ার। প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিলেন তারা। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মীও নিয়োগ দেন। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়ে এবং বুথ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করতেন। প্রতিটি সার্টিফিকেট প্রদানের বিনিময়ে তারা ৫ হাজার টাকা করে নিতেন।