চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে আরো বিস্তৃত করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে বাড়ানো হচ্ছে ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, ঘুষ দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম। এরই অংশ হিসেবে গতকাল একসাথে ৪০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সাথে ১১ ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর আগে ২২ জনের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ৩৩ ব্যক্তির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
জানা গেছে, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, এমন চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে দুদক। গতকাল বুধবার দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপককে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বলে দুদক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এ দিকে গতকাল গণপূর্ত অধিদফতরের ছয় নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১১ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুদক। ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গতকাল বুধবার পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইমিগ্রেশন বরাবর অনুসন্ধান দলের প্রধান ও সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এর আগে সংসদ সদস্যসহ ২২ ভিআইপির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল।
গতকাল দুদকের চিঠিতে বলা হয়, চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অনুসন্ধান কিংবা মামলা চলমান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দিন দিন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বিস্তৃত করা হচ্ছে। প্রথমে যাদের নাম ছিল পরে আরো বড় ভিআইপিদের এ তালিকায় আনা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সন্দেহভাজনদের তালিকা অনুযায়ী তথ্য দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নির্ভুল তথ্য দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিএফআইইউ চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তাও রয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চলমান অনুসন্ধান ও মামলাগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জব্দকৃত হিসাবগুলোর বিবরণীসহ প্রকৃত অর্থ লেনদান সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। দুদকের সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে জব্দ করা ওই চার শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব বিবরণী ও প্রকৃত আর্থিক লেনদেনের তথ্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করার জন্য চিঠিতে অনুরোধ জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান।
৩৩ জনের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে দুই সংসদ সদস্য, ব্যাংক পাড়ায় বহুল আলোচিত একটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত এমডিসহ সরকার দলীয় বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রয়েছেন বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞার তালিকায়। ৩৩ জনের মধ্যে প্রথমে ২২ জন এবং গতকাল আরো ১১ জনের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা হওয়া প্রথম ২২ জনের মধ্যে রয়েছেন : চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। তালিকাভুক্ত অন্যরা হলেন : এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক পাড়ার রহস্য পুরুষ প্রশান্ত কুমার হালদার, গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইয়া, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ মো: লোকমান হোসেন ভূইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট এবং তার সহযোগী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানের (মিজান) বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরো রয়েছেন : গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু ও তার ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রুপন ভূইয়া, কেন্দ্রীয় যুবলীগের বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিছুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমান, লোকমান হোসেন ভূইয়ার স্ত্রী নাবিলা লোকমান, গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: আব্দুল হাই, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ। এ ছাড়া এনামুল হকের সহযোগী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদ (আজাদ রহমান), রাজধানীর কাকরাইলের জাকির এন্টারপ্রাইজের মালিক মো: জাকির হোসেন ও সেগুনবাগিচার শফিক এন্টারপ্রাইজের মালিক মো: শফিকুল ইসলামের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
গতকাল নতুন করে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা হওয়া ১১ জনের মধ্যে রয়েছেন : গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফজলুল হক, আব্দুল কাদের চৌধুরী, মো: আফসার উদ্দিন, মো: ইলিয়াস আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মোমেন চৌধুরী, মো: রোকন উদ্দিন, সিনিয়র সহকারী মুমিতুর রহমান এবং কর্মকর্তা সাজ্জাদুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত, ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর পরপরই দুদক তফসিলভুক্ত অবৈধ সম্পদের অপরাধ খতিয়ে দেখতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের টিম অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন : উপপরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলম, সালাউদ্দিন আহমেদ, গুলশান আনোয়ার প্রধান, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।