করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় দ্রুত টিকা প্রাপ্তির লক্ষ্যে তোড়জোড় শুরু করেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে করোনার টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীনসহ আরও যেসব দেশে টিকা ট্রায়ালে রয়েছে, সেগুলো সফল হলে বাংলাদেশ কীভাবে তা সহজে এবং স্বল্পমূল্যে পেতে পারে সে চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগ একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ রোডম্যাপ অনুযায়ী করোনার টিকা আমদানি, উৎপাদন বিষয়ে সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া টিকা আমদানি ও ক্রয়ে সরকার একটি তহবিল গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রয়োজনে নগদ টাকা দিয়ে টিকা কেনার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ।
গত ১০ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে ‘বিশ্বব্যাপী বাজার থেকে ন্যায্যমূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংগ্রহ’ শীর্ষক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আমদানি ও উৎপাদনের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। যাতে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশ জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। বৈঠকে ৮টি সিদ্বান্ত গ্রহণ করা হয়। বৈঠকের কার্যবিবরণী ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় পাঠানো হয়েছে। বৈঠকে সহজে স্বল্পমূল্যে করোনা ভাইরাসের নিরাপদ টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট ‘গ্যাভি’র (দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস) মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, গ্যাভি কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি নগদ টাকায় ভ্যাকসিন কেনার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ, ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও আমদানি পদ্ধতি জানার জন্য তহবিল সংগ্রহ, চীনের সিনোভ্যাক ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিদেশি সংস্থার সহযোগিতায় ভ্যাকসিন তৈরির জন্য স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যালসগুলোকে আর্থিক ও নীতি সহায়তা প্রদান এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।
জানা গেছে, বৈঠকে ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাধিকার পাবে বলে জানানো হয়। এ সংক্রান্ত একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনও উপস্থাপন করা হয়। সেখানে দেখান হয়েছে, ৬টি ভ্যাকসিন পরীক্ষার তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে। অনুমোদিত ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গ্যাভির মাধ্যমে দেশে আনা হবে।
বৈঠকে আরও জানানো হয়, আর্থিক ও ভৌগলিক এলাকা ভেদে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট গ্যাভির কোনো সদস্য দেশ যেন ভ্যাকসিন সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্য কোভেক্স ফ্যাসিলিটি কর্তৃক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ গ্যাভির কাছে এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট পাঠিয়েছে। গ্যাভির কাছে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ১২ দেশের যোগ্য তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেপ্টেম্বরে গ্যাভির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে ভ্যাকসিনের মূল্য এবং সদস্য দেশে ভ্যাকসিন বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশ গ্যাভির কো-ফাইন্যান্সার হিসেবে ভ্যাকসিন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বৈঠকে বলেন, ভ্যাকসিনের অর্থায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা মাথাপিছু আয় কম হওয়ায় ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা পাওয়া যায় কি না সে বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে থাকব না। তিনি আরও বলেন, ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যোগ্য হিসেবে আবেদন করার অনুমোদন পেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বৈঠকে বলেন, ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দেওয়ার বিষয়টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. কে জামান বৈঠকে বলেন, সিনোভ্যাক নামের একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে আইসিডিডিআরবির চুক্তি হয়েছে। অনুমতি পেলে ভ্যাকসিন তৈরির কাজটি অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করা যাবে। বাইরের দেশের ভ্যাকসিন অবশ্যই দেশে পরীক্ষা করতে হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বৈঠকে বলেন, ভ্যাকসিন গ্যাভির মাধ্যমে আগামী মার্চে আসতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি প্রয়োজন। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
আইসিডিডিআরবির পরামর্শক ডা. তাজুল ইসলাম বৈঠকে বলেন, ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না। আইসিডিডিআরবি গ্যাভির সাপোর্টে আগেও অন্যান্য ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রশিদ ই মাহবুব আমাদের সময়কে বলেন, ভ্যাকসিন বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন হলে নিতে হবে। আমাদের অন্যকিছু চাওয়ার নেই, আমরা ভ্যাকসিন চাই। প্রয়োজনে অগ্রিম অর্ডার দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে তাদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ভ্যাকসিন পাওয়ার পর যাতে দ্রুততম সময়ে আমরা ফল পেতে পারি এ জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করা, জনবল ঠিক করা দরকার। এসব কাজে সরকারের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া ভ্যাকসিন ট্রায়ালের পর অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা তাও পরীক্ষা করতে হবে। এ জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দিতে হবে। এ ছাড়া ভ্যাকসিনের জন্য আমাদের আইইডিসিআরকে আরও সক্রিয় হতে হবে।