করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা তৈরিতে বিশ্বজুড়ে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর মধ্যে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার তৃতীয় বা শেষ ধাপ তথা মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখার পর কে কার আগে এই টিকা বাজারে আনবে তা নিয়ে কোম্পানিগুলো এখন শামিল ইঁদুর দৌড়ে।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নানা দেশে বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি টিকা নিয়ে কাজ চলছে। তবে প্রতিযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৬টি কোম্পানি। কারণ এরই মধ্যে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত টিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ ধাপ চালাচ্ছে। যদিও এসব টিকার কোনটি করোনার বিরুদ্ধে ঠিক কতখানি কার্যকর হবে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়।
তবে প্রতিটি কোম্পানিরই দাবি, তাদের টিকা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। তাই প্রশ্ন উঠেছে, যদি এই কোম্পানিগুলোর টিকা পরীক্ষার তৃতীয় ধাপ সফলভাবে পেরিয়ে বাজারে আসে, তা হলে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে তো? এ বিষয়ে অবশ্য কোম্পানিগুলোর নানা মুনির নানা মত। অনেকেই বলছেন, সাধারণ মানুষ যেন টিকা সহজে কিনতে পারে সে বিষয়টি তারা মাথায় রাখছেন। আবার অনেক কোম্পানি বলছে, উৎপাদন খরচ পুষিয়ে আনতে প্রাথমিকভাবে টিকার দাম একটু বেশিই হতে পারে। পরে তা পর্যায়ক্রমিকভাবে কমানো হবে। দেখে নেওয়া যাক, করোনার সম্ভাব্য কয়েকটি টিকার বর্তমান অগ্রগতি ও আনুমানিক দামের চিত্র।
মেসেঞ্জার আরএনএ : যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মোর্ডেনা তৈরি করেছে করোনার বিরুদ্ধে টিকা ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’। সংক্ষেপে এই টিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘এমআরএনএ’। কোম্পানিটি জানিয়েছে, তাদের তৈরি আরএনএভিত্তিক এই টিকাটি অন্য ভাইরাল রোগের টিকার মতো নয়। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি আরেকটি ভাইরাস ব্যবহার করে না, বরং এমন একটি ভাইরাল প্রোটিন উৎপন্ন করবে যা করোনাকে অনুসরণ করে এটি নিষ্ক্রিয় করতে ভূমিকা রাখবে। টিকাটি বর্তমানে পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে আছে। মোর্ডেনা এর সম্ভাব্য দাম নির্ধারণ করেছে ভায়াল প্রতি ৩২ থেকে ৩৭ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩১শ টাকার বেশি।
আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসনও টিকা উৎপাদনে দেশটির সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এই টিকার প্রতি ডোজের দাম ধরা হয়েছে ১০ ডলার বা সাড়ে ৮শ টাকার মতো।
বিএনটি১৬২বি২ : মার্কিনিদের মতো জার্মান জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান পিফিজারও কাজ করছে আরএনএভিত্তিক টিকা ‘বিএনটি১৬২বি২’ নিয়ে। এটিও পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে আছে। কোম্পানিটি আশা করছে, আগামী অক্টোবরের মধ্যে তারা এই টিকা উৎপাদনের অনুমোদন পেয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কোম্পানিটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই টিকার ১০ কোটি ডোজ উৎপাদনে মার্কিন সরকারের সঙ্গে চুক্তিও সেরে ফেলেছে। বিএনটি১৬২বি২ টিকার প্রতি ডোজের দাম কোম্পানিটি আপাতত নির্ধারণ করেছে ১৯.৫০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১৬শ টাকা।
এজেডডি১২২ : এখন পর্যন্ত করোনার যে কয়টি টিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ‘এজেডডি১২২’। ইতোমধ্যে বিখ্যাত ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে মিলে তারা টিকাটি পরীক্ষার দুটি ধাপ সফলভাবে পার করেছে। এখন চলছে তৃতীয় ও শেষ ধাপের পরীক্ষা। অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা আশা করছে, আগামী সেপ্টেম্বরেই টিকাটির প্রথম চালান বাজারে আনতে পারবে। আশ্চর্যজনকভাবে এই টিকার দাম ধরা হয়েছে মাত্র ৪ ডলার বা মাত্র ৩৪০ টাকা।
নিউ ক্রাউন : চীনের জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম এরই মধ্যে তাদের তৈরি করোনার টিকার পেটেন্ট নিয়েছে। নিউ ক্রাউন নামে এই টিকার দুটি ডোজের দাম পড়তে পারে ১৪৫ ডলার বা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অন্যগুলোর তুলনায় চীনা এই টিকার বেশি দাম নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে সিনোফার্মের চেয়ারম্যান লিউ জিনহেং বলেছেন, ‘আমাদের টিকার দাম বেশি হচ্ছে না। প্রতিটি ইনজেকশনের জন্য ৭০ থেকে ৭৫ ডলার খরচ হতে পারে। দুই ডোজ মিলিয়ে ১৪০ থেকে ১৪৫ ডলার খরচ হবে। এর বেশি যাতে না হয় সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি।’
সিএইচএডওএক্স১ এনকোভ ১৯ : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এই টিকা উৎপাদন করছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। এই টিকার প্রতি ডোজের আনুমানিক দাম হতে পারে ১৩.২০ ডলার বা এক হাজার টাকার কিছু বেশি। তবে সেরাম ইনস্টিটিউটের মুখপাত্র সাইরাস পোনাওয়ালা জানিয়েছেন, টিকাটি তৈরি হয়ে গেলে ভারত সরকার দেশটির জনগণকে এটি বিনামূল্যে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
স্পুটনিক ভি : গত ১১ আগস্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বিশ্বের প্রথম করোনার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। যা তৈরি করেছে রাশিয়ার গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি। ‘স্পুটনিক ভি’ নামে এই টিকা করোনার বিরুদ্ধে শতভাগ কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে এখনো এই টিকার মূল্য ঠিক কত হবে তা জানায়নি রুশ কর্তৃপক্ষ।