দখল-দূষণে এবং বর্জ্যে ঢাকার চার পাশে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদী এবং টঙ্গী খালের করুণ দশা আরো বেড়েছে। আর পয়োবর্জ্যে নদীগুলোর দূষণের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসার। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল হওয়ায় নদীর পাড়ে অবাধে বর্জ্য ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনার দরুন এবং জনগণের সচেতনতার অভাবে কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। নদীতে থাকা বেশির ভাগ স্যুয়ারেজ লাইন ঢাকা ওয়াসার। তবে তীরে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্যুয়ারেজ লাইনও নদীতে যুক্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসা যথাক্রমে কঠিন বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকলেও নদীদূষণের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণে স্থায়ী সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সংস্থা দু’টি।
বাংলাদেশ ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার ২৩৭টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য এবং ২৫১টি পয়েন্ট দিয়ে পয়োবর্জ্য সরাসরি নদীর পানিতে পড়ছে। তুরাগের ৮৪টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য এবং ৪৮টি পয়েন্ট দিয়ে পয়োবর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ৩২টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য এবং ১০টি পয়েন্ট দিয়ে পয়োবর্জ্য পড়ছে বালু নদীতে। এর বাইরে ৪৭টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন ও শিল্পবর্জ্য এবং ৫১টি পয়েন্ট দিয়ে পয়োবর্জ্য টঙ্গী খালে ফেলা হচ্ছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার বলছে, মাঠপর্যায়ের জরিপ, জিপিএস মানচিত্র ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বুড়িগঙ্গায় ২৩৭টি ও তুরাগ নদে (টঙ্গী খালসহ) ১৩১টি বর্জ্যরে ভাগাড় পাওয়া গেছে। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে একসময় স্টিমার, লঞ্চ চলাচল করত। এক যুগ আগেও নদীটি কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, বসিলা হয়ে আমিনবাজারের কাছাকাছি গিয়ে ফের মূল বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ছিল। বর্জ্য ফেলে নদীটির মুখ বন্ধ করে ঘরবাড়ি, দোকানপাট গড়ে উঠেছে। দূষিত পানির গন্ধে নৌকা চালানোই দায় হয়ে উঠেছে মাঝিদের।
শুধু আদি বুড়িগঙ্গাই নয়, নদীটির মূল চ্যানেল ও তুরাগের দুই পাড়ের সাড়ে তিন শতাধিক জায়গায় ময়লায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। অনেক জায়গায় সীমানা থেকে ৪০ ফুট নদীর ভেতরে বর্জ্যরে ভাগাড়ে বেড়ে উঠেছে সাত-আট ফুট লম্বা গাছ। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে ঢুকলে নাকে লাগে পচা পানির উৎকট গন্ধ। পানির রঙ কুচকুচে কালো। কামরাঙ্গীরচরের উল্টো পাশে ইসলামবাগের একই স্থানে অন্তত আধা কিলোমিটার নদীর সীমানাজুড়ে বর্জ্য ফেলায় ভরাট হয়ে গেছে নদী। ভরাট জায়গায় উঠেছে দোকানপাট। কামরাঙ্গীরচর অংশেও একই অবস্থা। ফলে সরু হয়ে গেছে চ্যানেল। চ্যানেলটির মুখ থেকে লোহারপুল পর্যন্ত নদীর দুই পাশেই কিছু দূর পরপর এমন ময়লার ভাগাড়। দূষিত হয়ে পড়েছে দুই পাড়ের পরিবেশও। রসূলবাগসহ পুরো জিনজিরা এলাকাতেও নদীর পাড়জুড়ে ময়লার ভাগাড়। ঢেকে গেছে নদী রক্ষার সিসি ব্লক। বর্জ্য ফেলার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নদীতেই বর্জ্য ফেলা হয়। তুরাগ নদের মিরপুর বেড়িবাঁধ অংশের সিন্নিরটেক এলাকায় এখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন। ময়লার স্তূপ জমতে জমতে ছাড়িয়ে গেছে নদীর সীমানাপ্রাচীর। এতে নদীদূষণের পাশাপাশি চরম দুর্ভোগে এলাকাবাসী। বড়বাজার এলাকায় দু’টি বর্জ্যরে ভাগাড় রয়েছে। টঙ্গী খালের দুই পাড়েও বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে চ্যানেল। ফলে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতে বর্জ্য ফেলায় এগুলোর করুণ দশা।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণ থেকে বাঁচাতে না পারলে সরকারের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। নদ-নদী উদ্ধারে এক দিকে চলছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান, অন্য দিকে বর্জ্য ফেলে চলছে নদী ভরাটের আয়োজন। তাই নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করতে আদালতের রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য প্রয়োজন নদীর সীমানা ঠিকমতো চিহ্নিত করা, প্লাবন অঞ্চলকে নির্দিষ্ট করা এবং নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া। তা না হলে নদীগুলো স্থায়ীভাবে অবয়ব হারিয়ে খালে পরিণত হবে। ঢাকার নদী রক্ষায় এখন প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।