আমাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ আর জীবন-সংসার নিয়ে যা কিছু স্বপ্ন, ভাবনা ও অভিপ্রায় তার মনোরম প্রকাশ দেখি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক বা পরে, অনেকেই কবিতাচর্চা করে গেছেন; কিন্তু জীবনানন্দর কবিতায় মনের মাধুরী মেশানো ভঙ্গি ও শিল্পকুশলতা যেভাবে প্রতিভাত হয়েছে, এর তুল্যমূল্য দেখা যায় না।
জীবনানন্দ দাশ অনুভূতির এমন এক স্তরে পৌঁছে কবিতাচর্চা করে গেছেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সৃজনশীলতার সেই শিখর স্পর্শ করে ওঠা প্রায় অসম্ভব। মানুষের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের যে ছন্দ ও অভীপ্সা, সেখানে তিনি ভীষণরকম উদাসীন ও অসফল ছিলেন; কিন্তু শিল্পচর্চায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত হিসেবি, সতর্ক ও লক্ষ্যভেদী। আমাদের মানসরাজ্য এবং অনুভবের সমস্ত তন্ত্রী খুলে খুলে যায়, তার কবিতা পাঠ করলে। কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি এক দুর্মর-জীবনতৃষ্ণা-জাগিয়ে-দেওয়া অনুভূতির প্রবাহ তৈরি করেন। এদিক থেকে তিনি এক নিঃসঙ্গ শিল্পনাবিক; যিনি এক অপরূপ ও প্রাতিস্বিক সৃজনভুবন তৈরি করে গেছেন, যার আকর্ষণ বারবার পাঠেও ফুরোয় না। কবিতাভুবনের নতুন অভিযাত্রীরা তার কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অজান্তেই সেঁটে যান, প্রভাব যন্ত্রণায় নিজের পথ ভুলে যান। গল্প-উপন্যাসেও তিনি একইভাবে নতুন পথের সন্ধান করেছেন।
হেমন্ত ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম ঋতু। আর সেই হেমন্তের এক রাতেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ২২ অক্টোবর সেই বিরহছোঁয়ানো দিন, যেদিন তিনি তার সমস্ত শিল্পপ্রচেষ্টার কিছু শেষ করে, কিছু অসমাপ্ত এবং বেশিরভাগই অপ্রকাশিত রেখে নির্ভার চোখ বুজেছেন। কিন্তু তার প্রয়াণের এত বছর পর, যে মানুষটি বেঁচে থাকতে উল্লেখ করার মতো একটা জীবন পাননি; সবখানেই খামতি ও বেদনার গল্পজুড়ে ছিল দগদগে ঘায়ের মতো; ভালো কোনো চাকরি পাননি, বউ ভালোবাসেনি, নিজের বাড়িতেও থাকতেন বহিরাগতের মতো, কিছুটা নাম হওয়ার পরেও তার লেখা ফেরত আসত; সেই মানুষটি প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করতেনÑ সামাজিক প্রভাব আর সাহিত্যিক দাপট আলগা হয়ে এলে কে শ্রেষ্ঠ তা সময়ই বলবে। একদিন তার লেখার যথার্থ সমাদর হবে, বাজারে খুব বিকোবে তার লেখাপত্র; সেদিন হয়তো তিনি থাকবেন না।
সেই সময়ের শিক্ষা সচিব হুমায়ুন কবিরকে লেখা চিঠিতে এর আভাস পাওয়া যায় : ‘…আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না, আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতোও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু-যা শেষ বিচারে কোনো একটা জিনিসের-মতো-জিনিস-কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’ কবির সাহেবেকে লেখা তার চিঠির মর্মকথাটুকু কী নিদারুণ সত্য হয়ে ফলেছে, তার শত্রুও তা জেনে গেছে।
জীবদ্দশায় তিনি অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য ও অসংলগ্ন বলে চিহ্নিত ছিলেন, আর প্রায়-অস্বীকৃত বা কেবল ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ছিলেন উন্মোচিত; মৃত্যু-পরবর্তীতে তিনিই পাঠক-সমালোচকদের কাছে হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে প্রিয়।
কবিতায় তিনি একটানা মায়াবী-আচ্ছন্ন করা সুর গেঁথে দিয়েছেন, গল্প-উপন্যাসেও জীবনের বহুস্তর-অনুভূতি-বিবেচনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বর্তমান জীবনের কথাই লিখছেন তিনি-আমাদের সমসাময়িক জীবন ও শিল্পভাবনার রূপকার জীবনানন্দ দাশ।
মৃত্যুর পর, অনেক কবি ও শিল্পী হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস, গল্পকার জগদীশ গুপ্ত প্রমুখ বেঁচে থাকতেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। অনেকে মৃত্যুর পরে নতুন করে জেগেও ওঠেন। জীবনানন্দ মৃত্যুর পরই নতুন জীবন পেয়েছেন সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে। তার সৃষ্টিজগৎ ঘিরে নিয়ত কৌতূহল ও চর্চা বাড়ছে, ব্যক্তি জীবনানন্দকে নিয়ে তো বটেই।
আমি মূলত গল্প লেখার চেষ্টা করি। জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সময় নিয়ে দীর্ঘ উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই বয়ে বেড়াচ্ছি। উপন্যাসের অনেকখানি তৈরিও হয়ে গেছে। একসময় জীবনানন্দ-চর্চার একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা প্রকাশে অনুপ্রাণিত হই, স্বপ্নপ্রণোদনায়। এমন একটি পত্রিকা, যেখানে জীবনানন্দ-সম্পর্কিত কবিতা-গল্প-ভাবনা-স্কেচ-তথ্য-সংবাদ-আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হবে। ২০১৮-তে, কবির প্রিয় হেমন্ত-ঋতুতেই প্রকাশিত হয় জীবনানন্দর প্রথম সংখ্যা। গত জুলাইয়ে বেরিয়েছে দ্বিতীয় সংখ্যা।
১৯৮৪ সালে আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘জীবনানন্দ’ নামে একটি কাগজ করেছিলেন, দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, সেটি ছিল জীবনানন্দ-কেন্দ্রিক; বাকি আর-যেসব-কাগজের সন্ধান পেয়েছি জীবনানন্দ নামে-ঢাকা থেকে হারুন হাবীব ও বরিশাল থেকে কবি হেনরী স্বপনের সম্পাদনায়, তা জীবনানন্দ-চর্চার কাগজ নয়। আমরা, বাজার থেকে একটু সুগন্ধি কিনে তার সৌরভ জনতার মাঝে বিলাতে চাইনি, নতুন একটি সুগন্ধি-প্রতিষ্ঠান নির্মাণের অভিপ্রায়ে এ স্বপ্ন-পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়েছি। সেই স্বপ্নের নাম জীবনানন্দ।