দেশের সরকারি প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দীর্ঘ দিন ধরে দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম না থাকলেও অনেক দিন ধরে দেশের শিক্ষাঙ্গনে চলছে অস্থিরতা। পুরো শিক্ষাক্ষেত্রে নানামাত্রিক সঙ্কট বিরাজ করছে। একের পর এক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নানা দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের আর এর মাধ্যমে বের হয়ে আসছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারা দেশে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। একই সাথে ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, কমিশনবাণিজ্য, প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার, আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানা ধরনের কলঙ্কিত ঘটনার চিত্রও বের হয়ে পড়ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সূত্র ধরে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন এসব অনিয়ম দূর করা ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে, আবার কখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনার জেরে গড়ে উঠছে আন্দোলন। আর এসবের মাধ্যমে বারবার গোটা জাতির সামনে যেটি প্রকাশ হয়ে পড়ে তা হলো বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নামে মাত্র রয়েছে ভিসি ও প্রশাসন। দীর্ঘকাল ধরে অকার্যকর প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণে দেশের নাম করা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এর ফলে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের সবচেয়ে নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শুধু লাঞ্ছিত নয়, অমানবিক নিষ্ঠুরতারও শিকার হচ্ছে। এসব ঘটনা মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে আসে যখন আবরারের মতো কোনো মেধাবী ছাত্রের লাশ বের হয় বুয়েটের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল থেকে। নোংরা শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম দলবাজদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ, দলীয় ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা কারণে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অরাজক পরিস্থিতি চলছে বলে অনেকে মনে করেন।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে অনিয়ম দুর্নীতি দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত ঘটনা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ অনেক শিক্ষকের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে শুধু শিক্ষকসমাজ নয় বরং দেশের অনেক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে স্থান না পাওয়াসহ নানা কারনে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান। সব মিলিয়ে গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
গত কয়েক মাস ধরে একের পর এক কোনো-না-কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক অনেক অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠ খবর ও তথ্য প্রকাশের পরও তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না নানা কারণে। ফলে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সচেতন মানুষের মনে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছে; কিন্তু অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চলছে অচলাবস্থা। এ নিয়েও ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বর্তমানে সবচেয়ে উত্তাল পরিস্থিত বিরাজ করছে দেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিসি ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনেক দিন ধরে শিক্ষার্র্থী ও শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। অনেক দিন ধরে দেশজুড়ে আলোচিত বিষয় জাবিতে দুর্নীতি, অনিয়ম, কমিশনবাণিজ্যসহ অনিয়মের নানা অভিযোগ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকার্যক্রম থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগে বিদায় নিতে হয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। ঘটনা এত দূর পর্যন্ত গড়ালেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি ভিসি ফারজানার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের। বরং আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর ছাত্রলীগের প্রতি ভিসির কৃতজ্ঞতা জানানোর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে কারা কিভাবে অনেক দিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে এ চিত্র কম বেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র আববারকে ছাত্রলীগ পিটিয়ে হত্যার মাধ্যমে জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলা কালো অধ্যায়ের। জাতি আবারো জানতে পারল দেশসেরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগের নির্মমতার শিকার হচ্ছেন। আবরার হত্যার ঘটনায় প্রকাশ হয়ে পড়েছে কিভাবে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হলগুলোর প্রশাসন। বের হয়ে পড়েছে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির ঘৃণ্য চিত্রও। অনেক দিন ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা বিরাজ করছে তার মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা। একই সাথে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নানা অপকর্ম।
বুয়েটে আবরার হত্যার মর্মান্তিক ঘটনার আগে সম্প্রতি ভিসিবিরোধী আন্দোলনের কারণে যে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় দেশজুড়ে আলোচিত হয় তা হলো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
দীর্ঘ দিন ধরে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া দেশের ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজেও। এ নিয়ে বর্তমানে প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও আরো নানা কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়াই ছাত্রলীগের ৩৪ জনকে ভর্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদ শিরোনাম হলেও এ নিয়ে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারেনি সেখানে।
এ দিকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছেন। আগামী ১৩ তারিখের মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে আসন্ন সমাপনী পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাইস্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণের। এ নিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।