দেশে প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজারে গত এক সপ্তাহ ধরে বিরাজ করছে অস্থিরতা। অথচ এখন আমনের ভরা মৌসুম। বাজারে নতুন ধান উঠেছে। তাই দাম কমার কথা; কিন্তু বেড়েছে, এটিই বাস্তবতা। মিল থেকে শুরু করে খুচরা সব পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে মোটা চাল প্রতি বস্তায় বেড়েছে ১০০ টাকা। সরু চাল বস্তায় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। আর কেজিতে বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ টাকা।
যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকলেও চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দেশে এমন কী হলো যে, চালের দর বেড়ে গেল? বাজার অর্থনীতির মূল কথা হচ্ছেÑ চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি না থাকলে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তখন ওই পণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু আমাদের দেশে এই তত্ত্ব যেন অকার্যকর। বরং ছলচাতুরী করে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে অশুভ আঁতাত গড়ে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। ফলে আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনেও এই কারসাজিকেই দায়ী করা হচ্ছে। এমন অভিযোগের সত্যতা রয়েছে।
কোনো কিছুর দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাহানার অন্ত নেই। ব্যবসায়ীদের দাবি, আমনের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অন্য বছরের চেয়ে কম হয়েছে। তাই বাজারে ধানের আমদানি কম। এর জন্য দফায় দফায় বন্যায় ক্ষতিসহ নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন তারা। খুচরা বিক্রেতারা দোষ দিচ্ছেন পাইকারদের। আর পাইকাররা দুষছেন মিল মালিকদের। এ দিকে মিল মালিকরা বলছেন ধানের বাজার চড়ার কথা। এতে ভোগান্তির শিকার সাধারণ ভোক্তারা। এক দিনে হঠাৎ তিন-পাঁচ টাকা কিভাবে প্রতি কেজিতে চালের দাম বাড়ে তা বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। সবার প্রশ্নÑ কিভাবে এটি সম্ভব? চার দিক থেকে অভিযোগ উঠেছেÑ ‘সবই হচ্ছে সিন্ডিকেটের কারসাজি।’ যে ব্যবসায়ী এক মাস আগে দোকানে চাল তুলেছেন, তিনি তো আর পাইকারি আড়ত থেকে বেশি দামে চাল কেনেননি। তার দোকানে চালের দাম বাড়বে কেন? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মিলছে না।
শুধু চাল নয়, নতুন আলুর দাম কমে দুই দিন আগেও ছিল কেজি ৪৫ টাকা। আবার বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। পুরনো আলু এখনো বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি দরে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু ওই দামে কোথাও আলু বিক্রি হয় না। অন্য দিকে, গত সপ্তাহেও ১০০ টাকায় ১৫টি ডিম পাওয়া যেত। আর এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এক ডজন। মাঝে ১০০ ডিম ফার্ম থেকে ৬০০ টাকায় কেনা যেত। এখন বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। পেঁয়াজ এখনো জনসাধারণকে উচ্চমূল্যেই কিনতে হচ্ছে। বাজারে ভালো পেঁয়াজ ৮০ টাকায় দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় আকৃতির আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০ টাকায় পাওয়া যায়। কাঁচামরিচের দাম কিছুটা কমে এখন ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মূলত বাজারে নজরদারি ভেঙে পড়ায় এমন হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ কারণে বাজারের এই অবস্থা। এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, সরকারের নজরদারির অভাবে দেশে এখন চাইলেই যে কেউ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। ব্যবসায়ীদের এই চক্রের সাথে সরকারের উপর মহলের কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাদের কেউ এই চক্রের সাথে জড়িত কি না তা-ও দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর কারণ দেখা যাচ্ছেÑ নীতিনির্ধারণ জনবান্ধব নয়। সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। সে জন্য নাগরিকদের মধ্যে মাঠপর্যায়ে অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাবান কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে ব্যবসায়ী চক্রকে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
আমরাও মনে করি, বাজারে নজরদারি জোরদার করা হলে এভাবে রাতারাতি কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব হতো না। তাই সরকারের নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। একই সাথে, চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর নেপথ্য কারিগরদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনলে কেউ কারসাজি করার সাহস পাবে না। জনসাধারণের কথা বিবেচনায় নিয়ে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে সরকারকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে করোনাকালে মানুষের জীবন ধারণ আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।