হৃদয় আলম:
শিক্ষকদের স্বার্থবাদী রাজনীতি আর উপাচার্যদের একগুঁয়েমি আচরণের কারণেই বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে দেশের একমাত্র আবাসিক ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। ১৯৯০ সালের পর থেকে বেশির ভাগ সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্থির ছিলো উপাচার্য অপসারণ বা নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়, আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা বিএনপিপন্থীদের ক্ষমতা থেকে নামাতে সোচ্চার আবার বিএনপিপন্থীরা আওয়ামী লীগপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া সরকারের উত্থান-পতনও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রায় ৭০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা ছিলো চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন সৈয়দ আলী আহসান। শুরুতেই তিনি নতুন বিভাগ খোলা ও শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেন। সেই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সালাউদ্দিন আহমেদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আই চৌধুরী, কাজী সালেহ আহমেদ প্রমুখ।
এরপর ১৯৯৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একসময়ের শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে একগুঁয়েমিভাবে কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে শুরু করেন। যা সে সময় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। এরপর শিক্ষার্থী ও উপাচার্য পদপ্রত্যাশী শিক্ষকদের একটি অংশের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন আলাউদ্দিন আহমেদ।
আলাউদ্দিনের পদত্যাগের পর দায়িত্ব পান অধ্যাপক আব্দুল বায়েস। তিনি আওয়ামীপন্থী হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের বেশ বড়সড় ধাক্কা খান। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে ড. বায়েসকে নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ ও লাঞ্ছিত করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মতাদর্শের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ সময় তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যেসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে।
এরপর বিএনপি প্রশাসন অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদকে (২০০১-২০০৪) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু বায়েসের কাছ থেকে চেয়ার কেড়ে নেওয়া উপাচার্য জসীমউদ্দিন আহমেদও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। শিক্ষক আন্দোলনের মুখে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ঘোষণা করেন এবং তাতে হেরে তিনি বিদায় হন।
এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে মোস্তাহিদুর রহমানকে উপচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পদে বসার পর মোস্তাহিদুর রহমানও জনপ্রিয় শিক্ষক থেকে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শেষে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে। পরে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু তিনি বিদায় নিতে নিতে তার মেয়াদকাল শেষ হয়।
মোস্তাহিদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হলে অস্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করা হয় অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামানকে। তিনি ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এলে রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরকে উপাচার্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সে সময় বিএনপিপন্থী শিক্ষক ও আওয়ামী লীগপন্থীদের একাংশের অভিযোগের মুখে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনে একরকমের অচল হয়ে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম। সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন শরীফ এনামুল কবির।
এরপর ২০১২ সালের ২০ মে নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই শিক্ষকদের রোষানলে পড়তে থাকেন তিনি। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল হেফাজতের মহাসমাবেশ শেষে জাবির ডেইরি গেটে একটি ছাত্রসংগঠনের নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ এনে তার বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা। লাগাতার আন্দোলন ও অবরোধের মুখে আনোয়ার হোসেন ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক আবদুল মতিন। তিনি ফারজানা ইসলাম নিয়োগ পাওয়ার পর তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আবদুল হামিদ উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহ-উপাচার্য এম এ মতিনকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেন। এরপর রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে ফারজানা ইসলাম প্রথম এবং মো. আবুল হোসেন দ্বিতীয় হন। এরপর ২ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর ছোটখাটো কিছু আন্দোলন হলেও চার বছরের মেয়াদ শেষ করেন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু এই মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়ার পর উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে তাকে অপসারণের জোরালো দাবিতে আন্দোলন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে আন্দোলনটির প্রথম আলোড়ন শুরু হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। অভিযোগটি ছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি করেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। উপাচার্যও তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন। এর ক’দিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সংগঠন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে আন্দোলনকারীদের।
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, যেখানে কোন টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে কিভাবে দুর্নীতি হল? কোথায় টাকা গেলো সেটাতো আমরাও জানতে চাই। আন্দোলনকারীদের সুনির্দিষ্ট করে করে বলতে হবে কোথায় টাকা গেলো। মিথ্যা অভিযোগ করলে আমাদের প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুসারে সেটার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব আমরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দু’দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হল ছাড়ার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ছাত্র-শিক্ষকদের একটি অংশ সেখানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই উপাচার্যকে তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। সেখানে তারা ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
আন্দোলনকারীদের ‘শিবির কর্মী’ বলে আখ্যা দেন উপাচার্য এবং তিনি ছাত্রলীগকে তাকে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানান।
এমতাবস্থায় অনেকের মতে মেধা, দক্ষতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার মাপকাঠি নয়। সেখানে এই শীর্ষ পদে টিকে থাকতে চাইলে প্রথমেই সহকর্মী শিক্ষকদের সামাল দেওয়ার দক্ষতা থাকতে হবে।