শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৪৮ অপরাহ্ন

উৎকণ্ঠায় শিক্ষার্থীরা এখন ধৈর্যহারা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ১৭০ বার

করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত বছরের মার্চ থেকে অর্থাৎ প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে করে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাভাবে বন্ধের উপক্রম। তবু সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছে সরকার। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ধৈর্যচ্যুতিও ততই বাড়ছে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল খুলে দেওয়া এবং ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার দাবিতে চলছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শুরু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থান শুরু করেন। দ্রুতই এমন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীসহ সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, সংক্রমণের হার আরও হ্রাস পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে, সবার আগে জীবন।

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পর ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বেড়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ ছুটি থাকবে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলনের মুখে গত সোমবার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতরের পর আগামী ২৪ মে খুলবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়। এর এক সপ্তাহ আগে ১৭ মে খুলে দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল। এ সময়ের মধ্যে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাও এর মধ্যেই নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই হলে উঠে গেছেন তাদের অবিলম্বে হলত্যাগের আহ্বানও জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি ছাত্রছাত্রীদের আশ্বস্ত করে বলেন, ক্যাম্পাস খোলার এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিল রেখে বিসিএসে আবেদন ও পরীক্ষার তারিখ পেছানো হবে।

শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি বিভাগের চলমানসহ সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮টি সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চলমান পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সরকারি বেসরকারি কলেজগুলোতে স্নাতক (অনার্স) ও স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত বছর মার্চে। কয়েকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর করোনার বিস্তারে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো স্থগিত হয়ে যায়। প্রায় এক বছর পর, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে তা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সরকারের ঘোষণায় ফের স্থগিত হয়ে যায়। পরীক্ষা বন্ধ থাকায় ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।

সরকারি তোলারাম কলেজের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আরিফুর রহমান জানান, মাস্টার্স শেষ করতে পাঁচ বছর সময় লাগছে। তিনি খেদের সঙ্গে মন্তব্য করেন, সর্বত্র স্বাভাবিক চলাচল থাকলেও হঠাৎ করেই চলমান পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি অযৌক্তিক।

এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পরও গত বুধবার রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে পরীক্ষা বহালের দাবি জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বৈঠকে পরীক্ষা চালু রাখার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আন্দোলন থেকে সরে আসেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা স্থগিত থাকায় এর অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছেন। পরীক্ষা বহালের দাবিতে একই দিন আন্দোলনে নেমেছে বরিশালের বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরাও।

অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ক্লাস-পরীক্ষার বাইরে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর ফলে ঘটছে ধৈর্যচ্যুতি। আমাদের সময়কে এ শিক্ষাবিদ বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের সেশনজট বাড়ছে। এটিও তাদের ধৈর্যচুত্যির কারণ। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। বিদ্যমান সমস্যা যে মানুষসৃষ্ট নয়, প্রাকৃতিক- তা জানিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। করোনা মহামারীতে বিশ্বে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যেই আমরা (বাংলাদেশ) এখনো অনেক ভালো অবস্থানে আছি। এটা সম্ভব হয়েছে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে। সংক্রমণের হার আরও হ্রাস হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে হবে। জীবনরক্ষা সব কিছুর আগে, তা মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আমরা দেখেছি, করোনার মধ্যে অনেক দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার পর ফের বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এখন বিভিন্ন দেশে নতুন করে আবার করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। তাই আমাদেরও একটু সময় নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বিবেচনায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে এটা আমরা জানি। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমাদের কি করা উচিত, তা ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক। ইতোমধ্যে বিসিএস পরীক্ষার সূচি পেছানোর কথা জানিয়েছে সরকার। আমরা লম্বা সময় প্রাতিষ্ঠানিক পাঠাভ্যাস থেকে দূরে আছি। তবু বলব, জীবন বাঁচানোর তাগিদে আমরা আরও একটু ধৈর্য ধরি। দেখি, সংক্রমণের গতিবিধি। অবস্থা বুঝেই স্বাভাবিক লেখাপড়া চালু করতে হবে। অন্যথা আবাসিক হলগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

করোনা সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব ধরনের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে আর্থিক সংকটে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তা মেহরীন চৌধুরী। তিনি জানান, ইতোমধ্যে তাদের স্কুলভবনের কয়েকটি কক্ষ অন্য প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছেন। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে গেলেও শিক্ষার্থী-সংকটে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছেন না। মেহরীন বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর গত বছরের টিউশন ফিও বকেয়া রয়ে গেছে।

সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের এক শিক্ষক জানান, প্রতিষ্ঠানের আয় কমতে কমতে এমন দশা হয়েছে যে, ঋণ করে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত এককভাবে মন্ত্রণালয়ের নয়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ টেকনিক্যাল কমিটির মতামতের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে। যেহেতু মার্চে আমাদের দেশে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, এ জন্য আমরা আগামী মাস (মার্চ) সংক্রমণের হার পর্যবেক্ষণ করব।

করোনা সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য ও আইইডিসির উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার বন্ধ করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সব নাগরিকেরই দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে পরিস্থিতি বুঝে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি মানে, সংক্রমণের হার কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে থাকতে হবে।

গত বছরের মার্চ থেকে ক্লাস বন্ধ আছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। সাময়িক বা বার্ষিক পরীক্ষা তো বটেই, পাবলিক পরীক্ষা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা না নিয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়। অন্য শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে অটোপাস।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com